বিশ্বব্যাপী হ্যান্ডশেক প্রথার উদ্ভব ও ইতিকথা
পথে বা বাড়ীতে
হঠাৎ কোন অতি পরিচিত লোকের সাথে দেখা,
সাথে সাথে
অবধারিত ভাবে সামনে এগিয়ে এলো দুটি হাত, তারপর দুই
হাতের মিলন, মৃদু চাপ এবং ঝাকি।
যাকে বলা হয় হ্যান্ডশেক বা করমর্দন। বিশ্বের সকল দেশে কুশল বিনিময়ের সবচেয়ে আদর্শ
পন্থা এই করমর্দন। করমর্দন এখন শুধু কুশল বিনিময় নয় বরং এর রয়েছে বিশেষ তাৎপর্য।
পৃথিবীতে কবে কিভাবে করমর্দনের সূচনা হয় তা নিশ্চিতভাবে বলা কঠিন।
হ্যান্ডশেকের
উৎপত্তি নিয়ে সবচেয়ে বেশী প্রচলিত ধারনাটি হচ্ছে, প্রাচীনকালে
কোন আগন্তুক যখন কোন এলাকায় প্রবেশ করত তখন তার কাছে কোন অস্ত্র নেই এটা প্রমাণ
করার জন্য সে তার হাত সামনে বাড়িয়ে দিত। এখান থেকেই আজকের আধুনিক করমর্দন বা
হ্যান্ডশেকের সূত্রপাত। করমর্দনের ইতিহাসের উপর একটি বই লিখেছেন ব্রায়ান চালর্স
বার্ক। তার মতে অনেক আগে থেকেই করমর্দনের প্রচলন হলেও মূলত ঊনিশ শতকের দিকেই এটি
জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
করমর্দনের সূত্রপাতের বিষয়ে আরও ধারনা এই যে, প্রাচীনকালে কোন মানুষ শুধু মৌখিক কথার উপর বিশ্বাস করত না। বিশ্বাস পাকাপোক্ত করার জন্য পরস্পরের হাতে হাত মেলাত তারা। তাদের ধারনা ছিল এই করমর্দনের মাধ্যমে তাদের হাতের ছোয়া হৃদয়ে মিশে যাবে এবং বিশ্বাসের প্রতীক হয়ে উঠবে। বর্তমান সময়ে বিশ্বাসের প্রতীক হিসাবেও করমর্দনকে ব্যবহার করা হয়। সেজন্য আজকাল ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে বা কোন চুক্তিতে হাত ঝাকিয়ে করমর্দন করা হয়। করমর্দন প্রসারের ক্ষেত্রে মুসলমানদেরও রয়েছে বিশেষ অবদান। ইসলামী পরিভাষায় করমর্দনকে বলা হয় মুসাফাহা। যাকে রাসূল (সাঃ) সুন্নাত বলে ঘোষনা করেছেন। সেজন্য বিশ্বের যে অংশে ইসলামের আলো পৌছেছে সেখানে মুসাফাহার প্রচলন বা প্রসার বৃদ্ধি পেয়েছে। সেজন্য হ্যান্ডশেকের প্রসারের অবদানের ক্ষেত্রে মুসলমানরা গৌরবান্বিত হতে পারে।
ইতিহাসের
পাতায় পাতায় হ্যান্ডশেককে নিয়ে তৈরি হয়েছে নানান আনন্দ-বেদনার ঘটনাও। এন্টেনিয়াম
পাইয়াসের কন্যা দ্বিতীয় ফষ্টিনার সঙ্গে মার্কাস অরেলিয়াসের বিবাহের স্মৃতি অমর করে
রাখার জন্যে ১৪৫ সালে একটি মুদ্রা প্রচার করা হয়, যার মধ্যে বর
ও কনের করমর্দনের ভঙ্গিতে পরস্পরের হাত ধরে থাকার ছবি ফুটিয়ে তোলা হয়।
করমর্দনের
মাধ্যমে সম্পর্ক জোড়া লাগার ইতিহাসও আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান আত্নসমর্পনের
কিছুদিন পরেই ১৯৪৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর জাপানী সম্রাট হিরোহিতো এবং যুক্তরাষ্ট্রের
প্রধান কমান্ডার ডগলাস ম্যাকআর্থার মার্কিন দূতাবাসে পরস্পরের সাথে করমর্দনে মিলিত
হন।
সবচেয়ে দামি করমর্দনের ঘটনাটি ঘটে ১৯৭৫ সালের ১৫ জুলাই। অপোলো ও সুয়েজ মহাশূণ্যে পরস্পর মিলিত হয়। পশাপাশি আসার পর এদের মধ্যে সংযোগকারী একটি সেতু দিয়ে মার্কিন নভোচারী থমাস স্ট্যাফোর্ড ও রাশিয়ান মহাকাশচারী অলেক্সি লিউনভ হাত মেলান। মহাশুন্যে হওয়ার কারনে এটি সবচেয়ে দামী হ্যান্ডশেক। একাধিক হ্যান্ডশেক করারও রয়েছে মজার কাহিনী। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট নববর্ষের এক অনুষ্ঠানে ৮ হাজার ৫১৩ জন ব্যক্তির সাথে হ্যান্ডশেক করেন।
করমর্দন কোন
কোন সময় মৃত্যূও ডেকে এনেছে। ১৯৯৩ সালের ১৩ সেপ্টম্বর ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী আইজাক
রবিন এবং পিএলও চেয়ারম্যান ইয়াসির আরাফাতের মধ্যে হোয়াইট হাউসে একটা বৈঠকের আয়োজন
করা হয়, যার মধ্যস্ততাকারী ছিলেন বিল ক্লিনটন। এই
সময় সবার মনে একটাই প্রশ্ন, রবিন কি ইয়াসির
আরাফাতের হাতে হাত মেলাবেন? সেদিন ৩ হাজার দর্শক
হোয়াইট হাউসের লনে বসে সরাসরি এবং কোটি কোটি লোক টিভি পর্দার সামনে কৌতুহল ভরে
তাকিয়ে ছিল কি ঘটে তা দেখার জন্য।
শেষ পর্যন্ত
সবার প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে রবিন তার দীর্ঘ দিনের প্রতিদ্বন্দ্বীর দিকে হাত
বাড়িয়ে দিলেন, তবে তার হাত বাড়ানোর
আগে তিনি মুহুর্তের জন্য স্থির হয়ে গিয়েছিলেন। অবশ্য শেষ পর্যন্ত তিনি মুখে হাসি
নিয়ে আরাফাতের সাথে হ্যান্ডশেক করেন এবং কোটি কোটি জনতা তুমুল চিৎকারের মাধ্যমে
তাদের অভিনন্দন জানান। কিন্তু ২৫ বছর বয়স্ক ইহুদী ধর্মান্ধ ইয়াগাল আমির আরাফাতের
সাথে রবিরকে হ্যান্ডশেক করতে দেখে রাগে পাগল হয়ে গিয়েছিল।
তার রাগ এতই
চরম আকার ধারন করেছিল যে, ১৯৪৫ সালের ৪ নভেম্বর
তিনি রবিনকে হত্যা করেন। রবিনের মৃত্যূর পর নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার শিরোনাম ছিল
"একটি হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে রবিনের ভাগ্য নির্ধারন হয়ে গেল"।
কোন মন্তব্য নেই