Header Ads

অবিশ্বাস্য মাটির নীচে ৭০ দিন পর জীবিত উদ্ধার

অভিযানের বিষ্ময় হিসেবে মানুষ পাড়ি দিয়েছে চাঁদে, কিন্তু এবার যেন সেই বিষ্ময়কেও অতিক্রম করলো পাতাল থেকে ৭০ দিন পর ৩৩ জন মানুষকে উদ্ধার করার মাধ্যমে। খনি গর্ভে কাজ করার সময় সেখানে আটকে পড়েন ৩৩ জন শ্রমিক এবং নাটকীয়ভাবে ৭০ দিন পর তাদের জীবিত উদ্ধার করা হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে এটিই সবচেয়ে বড় উদ্ধার অভিযান। আর এই বিস্ময়কর ঘটনাটি ঘটেছে আমেরিকার দেশ চিলিতে।

লাতিন আমেরিকার দেশ চিলির উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত সান হোসের আতাকামা মরুতে অবস্থিত এক স্বর্ণ তামার খনিতে ২০১০ সালের আগস্ট কাজ করছিলেন বেশ কিছু শ্রমিক। হঠাৎ ধসে পড়ে খনির প্রবেশ সুড়ঙ্গটি। সঙ্গে সঙ্গে ভূগর্ভের হাজার ৩০০ ফুট নীচে আটকা পড়েন ৩৩ জন শ্রমিক। সেদিন সবাই নিশ্চিত ছিল যে, ওই ৩৩ জন শ্রমিকের সবাই মারা গেছেন। এরপর শুরু হয় বিষয়টি নিশ্চিত হতে খোঁজখবর।


আগস্ট বায়ুচালিত হাতলের মাধ্যমে উদ্ধারকর্মীরা নিচে নামার প্রথম চেষ্টা করেন। কিন্তু পথে নতুন করে আরেকটি গুহা ভেঙে পড়ায় তারা ফিরে আসতে বাধ্য হন। আগস্ট আটকে পড়া শ্রমিকদের অবস্থান জানতে উদ্ধারকর্মীরা পাঁচ ইঞ্চি ব্যাসের গর্ত খোঁড়ার কাজ শুরু করেন। ১৯ আগস্ট খননযন্ত্র প্রথমবারের মতো মাটির সবচেয়ে গভীরে পৌছালেও খনি শ্রমিকদের কাছাকাছি যেতে ব্যর্থ হয়। ২২ আগস্ট খননযন্ত্র হাজার ৩০০ ফুট গভীরে পৌছায়। আটকে থাকা শ্রমিকরা যেন প্রাণ ফিরে পান। তারা খননযন্ত্রের সঙ্গে লিখে পাঠান, 'আমরা ৩৩ জন বেঁচে আছি। 'কিন্তু কী আশ্চর্য, এও কি সম্ভব! হ্যাঁ, সম্ভব। কারণ, কথায় আছে না, রাখে আল্লাহ মারে কে!

এরপর শুরু হলো নিয়মিত যোগযোগ। জানা গেল, এই দীর্ঘ ১৭ দিন পাতালপুরীতে তারা পরিষ্কার পানি পেয়েছেন। পেয়েছেন আলাদা এক ধরনের খাবার, বলা যায় অনেকটা শালুকের মতো একটা কিছু, যা শুধু খাওয়ার যোগ্য বললে ভুল হবে, সুস্বাদুও। ছাড়া মাটির নিচে আগে থেকেই অক্সিজেন, পানি খাবার মজুদ করে রাখা একটি আশ্রয়ের সন্ধান পেয়েছিলেন তারা। মূলত এগুলো খেয়েই তারা ১৭ দিন বেঁচে ছিলেন। তাদের তো খোঁজ পাওয়া গেল, কিন্তু হাজার ৩০০ ফুট নিচ থেকে তাদের উদ্ধার করা যাবে কী করে? 'বেঁচে যখন আছে, উদ্ধার করা যাবেই, আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললেন খনিবিশেষজ্ঞদের একজন।

খাবার সরবরাহেরও রাস্তা বাতলে দিলেন তিনিই। তার ভাবনা অনুযায়ী শুরু হলো 'ডোভস' নামের একটি প্লাস্টিকের টিউব দিয়ে খাবার পাঠানো। ওই টিউবে পাঠানো হলো হাইড্রেশন জেল, স্যুপ প্রয়োজনীয় ওষুধ। এর দু-এক দিন পর থেকে চিকিৎসকের পরামর্শমতো পাঠানো শুরু হলো ভাত, রুটি, মাংসসহ ভারি খাবার। প্রতিদিন নিয়ম করে পাঠানো হতো সকালের নাশতা, দুপুরের খাবার, রাতের খাবার আর বিকালের জন্য চা বা কফি। কিন্তু শুধু খাবার পাঠালে কি আর চলে? অন্ধকার কুঠুরিতে থাকতে থাকতে তো তাদের জীবন বিপন্ন। জন্য পাঠানো হলো ৫০০ ওয়াটের ব্যাটারিচালিত একটি বাল্ব।

বাল্বটি পাঠানো হলো আরেকটি বিষয় মাথায় রেখে। পাতালবাসীরা যাতে কখন পৃথিবীতে দিন আর কখন রাত তা টের পান, সে জন্য সামঞ্জস্য রেখে বাল্বের আলো ভূপৃষ্ঠ থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হতো। কিন্তু এতেও যেন বন্দী মানুষগুলো স্বস্তি পাচ্ছিলেন না। স্বস্তি পাচ্ছিলেন না ভূপৃষ্ঠে থাকা তাদের স্বজনরা।


এর মধ্যে উদ্ধার অভিযানের প্রধান আন্দ্রে সুগারেট ঘোষণা দিলেন, খনিগর্ভবাসীদের উদ্ধারে অনেক সময় লাগবে। ডিসেম্বরে বড়দিনের আগে তো নয়ই। তখন পাতালবাসীর অনেকেই ভেবে নিয়েছেন যে, বাঁচার আশা বোধহয় আর নেই! কিন্তু কি করার আছে বলুন, ভূপৃষ্ঠে তো আর তাদের উদ্ধারে কম ফন্দিফিকির আঁটা হচ্ছে না। তাদের উদ্ধারের চিন্তায় চিলির সরকার থেকে নিয়ে বিশ্ব পর্যন্ত অস্থির।

বেশ কিছুদিন কেটে গেল এভাবে। বিশেষজ্ঞরা তাদের উদ্ধারে তিনটি পরিকল্পনা হাতে নিলেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী খোঁড়া হলো পৃথক তিনটি গর্ত। কিন্তু হায়, প্রথম পরিকল্পনা ব্যর্থ! দ্বিতীয় পরিকল্পনা অনুযায়ী, খনিগর্ভে প্রবেশের জন্য তৈরি করা হলো একটি খনিকূপ। সে কূপ দিয়ে পাতালপুরীতে প্রবেশের জন্য তৈরি করা হলো একটি উদ্ধার ক্যাপসুল। উদ্ধার ক্যাপসুলের দৈর্ঘ্য ছিল ১৩ ফুট, ব্যাস ২১ ইঞ্চি। নাম দেওয়া হলো 'ফিনিক্স' ফিনিক্সের ক্ষমতা ছিল মাত্র একজন বহন করার। সেভাবেই তৈরি করা হলো তা। কারণ হাজার ৩০০ ফুট নিচ থেকে তুলতে গিয়ে যদি ফিনিক্স ভার সইতে না পারে, তাহলে সর্বনাশ! সিদ্ধান্ত হলো উদ্ধার ক্যাপসুলের সাহায্যে কোনো একজন ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রবেশ করবেন খনিগর্ভে।

সেখানে প্রবেশ করে তিনি এক এক করে ফিনিক্সে তুলে দেবেন আটকে পড়াদের। কিন্তু কে যাবেন হাজার ৩০০ ফুট নিচে ওই মৃত্যুর ওই পাতালপুরীতে তাদের উদ্ধারে? সবার মনেই ভয় কাজ করছিল, যদি খনিগর্ভে প্রবেশের পর উদ্ধার ক্যাপসুল ফেইল করে! অবস্থায় এগিয়ে এলেন অসমসাহসী ম্যানুয়েল গঞ্জালেস। বললেন, 'আমার জীবনের বিনিময়ে যদি ৩৩টি প্রাণ রক্ষা পায়, এতে আমার আত্মা শান্তি পাবে।' বলেই উঠে পড়লেন উদ্ধার ক্যাপসুল ফিনিক্সে। খনিকূপ বেয়ে ১৭ মিনিটের মাথায় ফিনিক্স চলে গেল খনিগর্ভে। কোনো কিছুই যেন এর আগে উদ্ধার অভিযানের মতো বিপৎসঙ্কুল হয়ে ওঠেনি! গঞ্জালেস ফিনিক্সে প্রথম তুলে দিলেন ৩১ বছর বয়সী ফ্লোরেন্সিও অযাভালোসকে। স্থানীয় সময় রাত ১১টা ১১ মিনিটে ভূপৃষ্ঠে পা রাখলেন অযাভালোস। আহ্, যেন পরম এক মুক্তি! কিন্তু তখনো যেন তার ভয় কাটেছিল না। তাই অনেকটাই ছিলেন অনুচ্ছ্বসিত। কিছুক্ষণ পর সাত বছর বয়সী ছেলেকে জড়িয়ে ধরে সে কি কান্না! অযাভালোসের চোখ বেয়ে যখন কষ্ট ঝরছিল, অপেক্ষমাণদের অনেকের চোখেই ঝরছিল আনন্দাশ্রু।

চারদিকের সেই আনন্দ প্লাবিত করেছিল চিলির প্রেসিডেন্ট সেবাস্তিয়ান পিনেরাকেও। এর ঠিক এক ঘণ্টা পাঁচ মিনিট পর হলুদ ব্যাগ হাতে ভূপৃষ্ঠে উঠে এলেন ৩৯ বছর বয়সী মারিও সেপুলভেদা। তিনি উদ্ধার হওয়া দ্বিতীয় ব্যক্তি। তবে অযাভালোস শান্ত থাকলেও চিরচেনা পরিবেশে ফিরে উচ্ছ্বাস ধরে রাখতে পারেননি সেপুলভেদা। আনন্দে কয়েকবার লাফিয়ে ওঠেন শূন্যে। জড়িয়ে ধরেন চিলির প্রেসিডেন্ট সেবাস্তিয়ান পিনেরাসহ অন্যদের। দীর্ঘ যন্ত্রণার পাতালবাসের স্মৃতি হিসেবে তিনি সঙ্গে নিয়ে আসেন এক টুকরো পাথরও। সেপুলভেদার ঠিক এক ঘণ্টা পর উঠে এলেন হুয়ান ইলানেস। তিনি অবশ্য ফিনিক্সে করে ভূপৃষ্ঠে উঠে আসাকে তুলনা করলেন প্রমোদবিহারের সঙ্গে।

এরপর একে একে পৃথিবীপৃষ্ঠে উঠে এলেন আরো কয়েকজন। হোসে ওজদা হচ্ছেন সপ্তম সৌভাগ্যবান, যিনি ভূগর্ভবাসীদের একজন। আর ক্লাউদিও ইয়ানিয়েস উঠে এলেন অষ্টম ব্যক্তি হিসেবে। তিনি অবশ্য তার শিশুকন্যার কাছে ফিরতে পেরে ধন্যবাদ জানালেন ঈশ্বরকে। শিশুকন্যাকে বুকে জড়িয়ে ধরে শুধুই বললেন, 'আমার কাছে সবচেয়ে দুর্লভ আমার এই সন্তান। আমি আর কখনোই সোনার খনিতে যেতে চাই না।'


আটকে খাকা শ্রমিকদের মধ্যে ছিলেন ২৩ বছর বয়সী কার্লোস মামানি নামের এক বলিভিয়ানও। উদ্ধার অভিযানের মধ্য দিয়ে তাই বরফ গলল বলিভিয়া-চিলি সম্পর্কে। বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট হোসে মোরালেস জন্য আন্তরিক অভিনন্দন জানালেন চিলির প্রেসিডেন্ট সেবাস্তিয়ান পিনরাকে। বিশ্বব্যাপী আলোচিত উদ্ধার অভিযানের খবর সংগ্রহ করতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে হাজারেরও বেশি সাংবাদিক চিলিতে জড়ো হয়েছিলেন। ওই সময়টায় শ্রমিকদের পরিবারগুলো খনি এলাকার কাছাকাছি একটি অস্থায়ী শহর গড়ে তোলে। দুর্ঘটনার পর থেকে তারা সেখানেই বসবাস করছিল। নীল জামা পরা একদল নারী প্রতি সপ্তাহেই এখানে আসত। তারা গাজরের পিঠা আর ভাজা পনির মেশানো টাটকা রুটি অপেক্ষায় থাকা পরিবারগুলোর সদস্যদের মধ্যে বিলি করত।

৫৪ বছর বয়সী দলনেতা লুই উরজুয়াকে উদ্ধারের মাধমে শেষ হয় অভিযান। অভিযান শেষে চিলির প্রেসিডেন্ট সেবাস্তিয়ান পিনেরা উদ্ধার পাওয়া শ্রমিকদের জাতীয় বীর হিসেবে ঘোষণা দেন। ইতিহাসের সাক্ষী হতে পেরে আনন্দিত ফার্স্ট লেডি সেসিলিয়া মোরেলও। খ্যাতনামা লাতিন টিভি তারকা ডন ফ্রান্সিসকো উচ্ছাস প্রকাশ করে বলেন, '১৯৬৯ সালের প্রথম চন্দ্রাভিযানের পর এপোলো-১১ যখন ফিরে আসে তখন গোটা বিশ্বে তুমুল আলোড়ন তুলেছিল। আজ চন্দ্রাভিযানের সেই ঘটনাও নস্যি হয়ে গেলো।

২টি মন্তব্য:

  1. Obisshassho!! Shobcheye boro bir to shei bekti j, nijer lyf'r jhuki niye0 33lyf bachateo ready silo. Tini ki shomman pelen,jante isse korche..

    উত্তরমুছুন
  2. হ্যা, তার বীরত্ব হিসাবে তাকে দেশের জাতীয় বীর হিসেবে ঘোষনা দেয়া হয়েছে। কারন তিনি অসীম বীরত্বের পরিচয় দিয়েছেন।

    উত্তরমুছুন

Blogger দ্বারা পরিচালিত.