ঘড়ি আবিস্কারের ইতিহাস ও আধুনিকতা
জন্মলগ্ন
থেকে সময়ের হাত ধরে এগিয়ে চলেছে পৃথিবী। পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস হিসেবে ধরা হয় সময়কে। এক
একটি সেকেন্ড যেনো কোটি টাকার চেয়েও মূল্যবান। হবেও বা না কেন!
প্রতি সেকেন্ডে কত কিছুই ঘটছে
এই ধরাতে। আমাদের প্রাত্যহিক দিন অতিবাহিত হয় সময়ের সাথে।
বর্তমানে সময় দেখার জন্য প্রযুক্তির নানা উপাদান রয়েছে। ঘড়ি, মোবাইল, রেডিও, টিভি ইত্যাদি নানান উপাদানের মাধ্যমে আমরা সময় জানতে পারি। তবে আজকের এই দিনটি সহজে
আসিনি।
একটি
সময় ছিল যখন সময় জানার কোন উপায় ছিল না ফলে সময়
জানতে বিভিন্ন পদ্ধতির আশ্রয় নেয়া হতো। সেই আদিম পদ্ধতি থেকে আসতে আসতে আজকের কালযন্ত্রে এসে দাড়িয়েছে এই পৃথিবী। আসুন
আমরা জেনে নেয় কালযন্ত্রের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।
সূর্যঘড়ি :
এটি পৃথিবীর প্রথম যান্ত্রিক ঘড়ি। আনুমানিক সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগে মিসর ও ব্যাবিলনে এর উৎপত্তি হয়। সেই থেকে আজও টিকে আছে এটি। সেকেন্ড ও মিনিট কিছুই নেই, নেই কোনো টিকটিক শব্দ। তবু এটি সময় দেয় নিখুঁত। গোলাকার চাকতিতে একটি নির্দেশক কাঁটা ও দাগ কাটা সময়ের ঘর দিয়ে তৈরি এই সূর্যঘড়ি। খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থ বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টেও উল্লেখ আছে এই ঘড়ির কথা। সেখানে এই ঘড়ির নাম দেয়া ছিল 'ডায়াল অব আহাজ'।
পানিঘড়ি :
খ্রিস্টপূর্ব ষোড়শ শতকে মিসরে উৎপত্তি হয় পানিঘড়ি। তখন এর নাম রাখা হয় ক্লেপসাড্রা। এটার নিয়ম ছিল একটি বড় পাত্র থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় একটি ছোট পাত্রে পানি পড়ার মাধ্যমেই এগিয়ে চলবে সময়ের কাঁটা। নিচের ছোট পাত্রের সঙ্গে জুড়ে থাকতো একটি খাঁজযুক্ত দণ্ড। ওটাই একটু একটু করে ঘোরাতে থাকতো সময়ের গিয়ার। পানিঘড়ির হাত ধরেই পরবর্তীতে আসে দিন, মাস ও ঘণ্টার ধারণা। গ্রিকরাই প্রথম বছরকে ১২ ভাগে ভাগ করে। এরপর উপবৃত্তাকার কক্ষপথকে ৩৬০ ডিগ্রি ধরে তাকে ১২ দিয়ে ভাগ করেই পাওয়া গেল মাসের ৩০ দিন। মিসরীয় ও ব্যাবিলনীয়রা সূর্যের উদয়-অস্ত নিয়ে দিনকে দুটো সমান ভাগে ভাগ করল। এভাবে এলো ১২+১২=২৪ ঘণ্টা। সে সময় তাদের সংখ্যা গণনার ভিত্তি ছিল সেক্সাজেসিমাল তথা ৬০ = এখন যেমন ১০। এ কারণেই ঘণ্টা ও মিনিট ভাগ হলো সমান ৬০টি ভাগে।
পেন্ডুলাম :
জার্মানির পিটার হেনলেইন ১৫১০ সালে প্রথম স্প্রিং চালিত ঘড়ি আবিষ্কার করেন। তবে ওটা নিখুঁত সময় দিতে পারত না। এর নির্দেশকের গতিও ছিল বিক্ষিপ্ত। আরেক জার্মান গবেষক জোস্ট বার্জিও তৈরি করেন আরেকটি যান্ত্রিক ঘড়ি। তবে তাতেও সমস্যা ছিল অনেক। বার্জি মূলত জ্যোতির্বিজ্ঞানকে মাথায় রেখেই এটা তৈরি করেছিলেন। তা ছাড়া মিনিটের কাঁটা ছাড়া আর কোনো নির্দেশক ছিল না তাতে। ১৬৫৬ সালে পেন্ডুলাম চালিত প্রথম কার্যকর ঘড়ি আবিষ্কার করেন নেদারল্যান্ডসের বিজ্ঞানী ক্রিশ্চিয়ান হাইজেন। ডানে-বাঁয়ে হেলে-দুলে বেশ ভালোভাবেই ঘুরিয়ে দিত মিনিট ও ঘণ্টার খাঁজকাটা চাকতিগুলো। তবে প্রথম দিকে পেন্ডুলামের দুলুনির মাত্রা ছিল অনেক। প্রায় ৫০ ডিগ্রি। পরে তা ১০-১৫ ডিগ্রিতে নেমে আসে। ১৯০৬ সালে পেন্ডুলাম ক্লকের পিছনে প্রথমবারের মতো জুড়ে দেওয়া হয় ব্যাটারি।
কোয়ার্টজ ক্রিস্টাল ক্লক :
বিদ্যুৎ
কিংবা চাপ প্রয়োগে একটি নির্দিষ্ট ছন্দে কাঁপতে পারে কোয়ার্টজ ক্রিস্টাল ধাতু। এ ধর্মকে কাজে
লাগিয়ে ১৯২০ সালে আসে প্রথম কোয়ার্টজ ক্রিস্টাল ঘড়ি। এরই ধারাবাহিকতায় আসতে থাকে একের পর এক আধুনিক
ও দামি ঘড়ি।
ম্যাগনেটিক রিজোনেন্স :
সময়কে কেটেকুটে একদম অদেখার জগতে নিয়ে গেছেন বিংশ শতকের বিজ্ঞানীরা। সেকেন্ডের দশ ভাগের এক ভাগ বুঝতেই যেখানে গলদঘর্ম হতে হয়, সেখানে একশ কোটি ভাগের এক ভাগ তো কল্পনার বাইরে। ভাবতে ভাবতেই না জানি কত লাখ কোটি ন্যানো সেকেন্ড পেরিয়ে গেল। পরমাণুর কম্পনকে কাজে লাগিয়ে যে সময়যন্ত্র হতে পারে, এমনটি ১৮৭৯ সালে ভেবেছিলেন লর্ড কেলভিন। এর কার্যকর রূপটির আরেক নাম হচ্ছে ম্যাগনেটিক রিজোনেন্স। ১৯৩০ সালে যার সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন মার্কিন বিজ্ঞানী ইসিদর আইজাক রাবি।
এটমিক ঘড়ি:
বিজ্ঞানী ইসিদর আইজাক রাবির আবিষ্কারের ওপর ভিত্তি করেই ১৯৪৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ব্যুরো অব স্ট্যান্ডার্ডস প্রথম এটমিক ঘড়ি তৈরি করে। তবে তখন তা প্রচলিত কোয়ার্টজ ক্লকের চেয়ে নিখুঁত সময় দিতে পারত না। সেই সমস্যা কাটাতে এলো সিজিয়াম-১৩৩ পরমাণু। ১৯৫৫ সালে ব্রিটিশ গবেষক লুই এসেন ন্যাশনাল ফিজিক্যাল ল্যাবরেটরিতে বসে বানিয়ে ফেললেন প্রথম সিজিয়ামভিত্তিক এটমিক ঘড়ি। যে সিজিয়াম পরমাণুর ৯,১৯২,৬৩১,৭৭০টি কম্পনকে আমরা বলি ১ সেকেন্ড।
প্রথম
বাণিজ্যিক এটমিক ঘড়িটির নাম এটোমাইক্রন। ১৯৫৬-৬০-এর মধ্যে
যা বিক্রি হয়েছে মাত্র ৫০টি। তবে '৯০-এর পর
ঘড়ির জগতে তৈরি হতে থাকে একের পর এক মাইলফলক।
২০০৮ সালে পারদ ও এলুমিনিয়ামের আয়নকে
কাজে লাগিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব স্ট্যান্ডার্ডস এন্ড
টেকনোলজি তৈরি করে সভ্যতার সেরা এটমিক ঘড়ি। কোটি বছর পরও যে ঘড়ির সময়ে
এক সেকেন্ড হেরফের ঘটবে না।
বিশ্বের
একেক দেশের ঘড়িতে এখন একেক সময়। তবে মহাকালের ঘড়িতে কিন্তু সময় একটিই। বিজ্ঞানীদের ধারণা, ওই ঘড়িটা টিক
টিক করে উঠেছিল বিগ ব্যাংয়ের পর থেকেই। তার
আগে সময় ছিল ঘুমিয়ে। বিজ্ঞানের তত্ত্ব বলছে, আবার একদিন বন্ধ হয়ে যাবে মহাকালের ঘড়ি। হারিয়ে যাবে পৃথিবীও মহাকালের তলানিতে।
কোন মন্তব্য নেই