Header Ads

সোয়াজিল্যান্ডের উলঙ্গ এক রাজা ও রাজ্য

বিশ্বব্যাপী রাজা-মহারাজাদের কথা আমরা সবাই জানি। ইতিহাস ঘাঁটলে বিভিন্ন ধরনের বা বিভিন্ন স্বভাব চরিত্রের রাজা দেখতে পাওয়া যায়। যাদের মধ্যে কেউ আছেন বা ছিলেন দয়ালু, নিষ্ঠুর, রাগী, সরল, যোগ্য, অযোগ্য ইত্যাদি। বিশ্বে আবার এমন অনেক রাজা ছিলেন বা আছেন যারা যুদ্ধ-বিগ্রহ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, বা তাদের ভাল কাজের জন্য পরিচিত হয়ে আছেন। রাজা দেখতে পাওয়া যায় সেই সকল দেশে যে দেশে রাজতন্ত্র বিদ্যমান আছে। আজকাল দেশে দেশে গণতন্ত্রের চর্চা হওয়ায় রাজাদের প্রভাব কমে এসেছে। তবে যে সকল দেশে আজও রাজা আছে সেই সকল রাজাদের প্রত্যেকের স্বভাব চরিত্র কিন্তু এক নয়। এক এক জনের স্বভাব এক এক রকম। কোন কোন রাজা আবার সত্যিই ব্যতিক্রমী। যেমন বলা যায় সোয়াজিল্যান্ডে রাজার কথা। এই রাজার নাম মাখোসেতিভ ওরফে এমস্বোয়াতি থ্রি। তবে তিনিউলঙ্গ রাজানামেই সমধিক পরিচিত।


আফ্রিকা মহাদেশে অবস্থিত মাত্র ৪টি জেলা নিয়ে গঠিত ছোট্ট একটি দেশ সোয়াজিল্যান্ড। ২০০৯ সালের আদম শুমারি অনুযায়ী দেশটির জনসংখ্যা মাত্র ১১ লাখ ৮৫ হাজার। দেশের আয়তন মোট ১৭,৩৬৪ বর্গকিলোমিটার। সোয়াজিল্যান্ডের রাজধানী এমবাবেন। উত্তর থেকে দক্ষিণে ২০০ কিলোমিটার, পূর্ব থেকে পশ্চিম ১৩০ কিলোমিটার এই এলাকা নিয়ে সোয়াজিল্যান্ডের অবস্থান। দক্ষিণ আফ্রিকা আর মোজাম্বিকের গা ঘেঁষা এই দেশের অধিবাসীরা মূলত সোয়াজিরাই নামে পরিচিত। সিস্বোয়াতি তাদের মাতৃভাষা। সোয়াজিল্যান্ডের সরকারি ভাষা ইংরেজি।

এবার আসা যাক সোয়াজিল্যান্ডের উলঙ্গ রাজার সম্পর্কে। আফ্রিকা মহাদেশের লোকজন এমস্বোয়াতি রাজাকে উলঙ্গ রাজা বলে অভিহিত করে। মূলত রাজার কিছু অনৈতিক নিয়ন্ত্রণ হীন সামাজিক কাজকর্মের জন্য তার নাম এরূপ রাখা হয়েছে। উলঙ্গ রাজার চরিত্রের কাহিনী শুরু করার আগে তার পূর্ব পুরুষদের চারিত্রিক বৈশিষ্ঠ সম্পর্কে একটু জানা যাক। এমস্বোয়াতি থ্রি- বাবা কিং সোভুজা টু একদিকে যেমন একের পর এক বিয়ে করেছিলেন, তেমনই সোয়াজিদের বিভিন্ন গোষ্ঠী সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ করার কাজ চালিয়ে গিয়েছিলেন। কিং সোভুজা ৭০টি আবার কারোও মতে ১১০টি বিয়ে করেছিলেন। ২১০ জন ছেলেপুলে হয়েছিল তার। অনেকের মতে, রাজা এমস্বোয়াতির ভাই-বোনের সংখ্যা ছিল ২১০ এর বেশী। ৬১ বছর রাজত্ব চালিয়ে ৭৯ বছর বয়সে কিং সোভুজা যখন নিউমোনিয়ায় মারা যান, তখন তার নাতিপুতি সহ নিকট আত্নীয় স্বজনের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছিল।


১৯৬৮ সালের সেপ্টেম্বর ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে সোয়াজিল্যান্ড। সেই বছরের ১৯ এপ্রিল ভূমিষ্ঠ হন বর্তমান রাজা এমস্বোয়াতি থ্রি। যদিও এই এমস্বোয়াতিই যে ভবিষ্যতের রাজা হবেন তা পূর্ব নির্ধারিত ছিল না। কারণ, সোয়াজিল্যান্ডের রাজারা তাদের উত্তরসূরি মনোনীত করে যেতে পারেন না। রাজার মৃত্যুর পর রাজপরিবারের গণ্যমান্য সদস্যরা মিলে সিদ্ধান্ত নেন, শূন্য সিংহাসনে কাকে বসানো হবে। জন্য প্রথমে বাছাই করা হয় রানীদের মধ্যে একজনকে। তবে রানী নির্বাচনে শর্ত থাকে যে, সেই রানীই এই দায়িত্ব পাবেন যিনি শুধু এক ছেলেরই মা, সচ্চরিত্র এবং যার মধ্যে রাজমাতা হওয়ার সব গুণাবলী আছে। সেই রানীর ছেলের স্বভাব-চরিত্রও রানীর মতোই প্রশংসনীয় হতে হবে। পুত্র বিবাহিত হওয়া চলবে না।

কিং সোভুজা টু যখন মারা গেলেন তখন আজকের এই রাজা এমস্বোয়াতি ইংল্যান্ডের ডোরসেটে শেরবোর্ন বোর্ডিং স্কুলে পড়তেন। বয়স ছিল মাত্র ১৪ বছর। ভাবী রাজার হয়ে দেশ চালানোর জন্য প্রথমে বড় রানীকে বাছাই করা হয়েছিল। আর এই বড় রানী ছিলেন বর্তমান রাজার মা। আর সেই সুবাদে ভাবী রাজার মুকুট চলে আসে এমস্বোয়াতির মাথায়। চার বছর তার মা- রাজকর্ম চালান। পরবর্তীতে ১৯৮৬ সালে মাত্র ১৮ বছর দিন বয়সে এমস্বোয়াতি রাজা হন। হয়ে যান সোয়াজিল্যান্ডের এনগোয়েনামা তথা কিং লায়ন। এই রাজার রাষ্ট্রে সংসদ আছে, মন্ত্রীপরিষদও আছে। আছে হাইকোর্ট এবং আপিল কোর্টও। কিন্তু বাবার মতোই সংবিধান আইনের তোয়াক্কা করেন না তিনি, রাষ্ট্রে তার নির্দেশই শেষ কথা।

এমস্বোয়াতি থ্রিকে উলঙ্গ রাজা বলা হয় মূলত তার স্বভাব, চরিত্রের কারণে। তার রয়েছে পূর্ব পুরুষদের মতো বিয়ের বাতিক। তিনি একসময় আইন জারি করেছিলেন যে, আঠারো বছরের কম বয়সী কোনও বালিকাকে কেউ বিয়ে করতে পারবে না এবং তাদের সাথে কেউ যৌনসংসর্গে লিপ্ত হতে পারবে না। কেউ যদি এই অমান্য করে তবে তাকে জরিমানা হিসেবে একটি গরু বা সাড়ে হাজার স্থানীয় মুদ্রা জরিমানা দিতে হবে। কিন্তু এই আইন জারি করার কিছু দিন পর রাজা নিজেই ১৭ বছর বয়সী এক কিশোরীকে বিবাহ করে আইন ভঙ্গ করেন। তার রাণীদের মধ্য থেকে একজনকে তিনি বিয়ে করেন নিজেই অপহরণ করে। স্কুল থেকে ফেরার পথে তাকে অপহরণ করে প্রাসাদে আটকে রাখা হয়। পরে এই ঘটনা আদালত পর্যন্ত গড়ালে তিনি কিশোরীকে আদালতে বলতে বাধ্য করেন যে, সে রাজাকে ভালবাসে এবং সে রাজাকে বিয়ে করতে সম্মত আছে।

রানী

সোয়াজিল্যান্ডের জনগণ খুবই দরিদ্র। দরিদ্রতা থেকে নিস্তার পেতে এখানকার নারীরা রাজার বউ হতে চায়। প্রতি বছর সেপ্টেম্বরের শুরুতে রিড ড্যান্সের আয়োজন করে রাজা এমস্বোয়াতি। এই রিড ড্যান্স থেকে রাজা একজন কুমারীকে নিজের রানী হিসেবে বেছে নেন। তবে বিয়ে করেন গর্ভবতী হওয়ার পর। অর্থাৎ রিড ড্যান্স থেকে তিনি পাত্রী পছন্দ করেন। এর পর পাত্রীটি গর্ভবতী হলে তাকে সরকারিভাবে বিয়ে করেন। তারা কবে গর্ভবতী হবেন, সেই প্রতীক্ষায় থাকেন রাজা। কারণ রানীর সংখ্যা বাড়াতে বাড়াতে ১০০ করতে চান তিনি। বর্তমানে তার রাণী রয়েছেন ১৪ জন এবং সন্তান রয়েছে ২৪ জন।

ড্যান্সে অংশগ্রহণকারী মেয়েরা যে কুমারী তা বোঝাতে তাদের হাতে থাকে নেপালি খুকরির মতো এক ধরনের দা। সেই দা দিয়েই নলখাগড়া কেটে আনে তারা। চিতাবাঘ এবং সমগোত্রীয় অন্যান্য প্রাণীর চামড়া কেটে তৈরি সুপার মিনিস্কার্ট পরা এই মেয়েরা ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত অবস্থায় নাচে। সেই নৃত্যানুষ্ঠানের দৃশ্য ভিডিওতে তুলে রাখা হয়। রাজা তার অবসর সময়ে সেই ভিডিও দেখে সুন্দরীদের মধ্য থেকে ভাবী রানী নির্বাচন করেন। উদোম রাজার নিজের নিম্নাঙ্গের কিছুটা ঢাকা থাকে কাপড়ে, তার উপরে সিংহের চামড়া।

সেই ১৯৯৯ সাল থেকে এই রাজা এভাবেই একের পর এক রানী বেছে আসছেন। রাষ্ট্রের রাজা যখন নিজেই এমন চরিত্রের অধিকারী হন তখন নিশ্চয়ই তার দেশের জনগণ উত্তম চরিত্রের অধিকারী হবেন না। আর এই অরাজকতার জন্যই সোয়াজিল্যান্ড বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে এইডস রোগে আক্রান্ত দেশ। এই দেশে বছরে যত মৃত্যু হয় তার ৬১ শতাংশই এইডস আক্রান্তে হয়ে। দেশে গর্ভবতী মহিলাদের ৪২ শতাংশই এইডসে আক্রান্ত। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ মহিলাদের মধ্যে এইডসে ভোগান্তির হার ৪৯ শতাংশ। শুধু ২০০৯ সালেই এই দেশে হাজার মানুষ এইডসসে মারা যায়। দেশের মানুষের গড় আয়ু মাত্র ৩২ বছর।

রাজা এমস্বোয়াতিকে উলঙ্গ রাজা বলার আরেকটি কারণ হচ্ছে তার স্বেচ্ছাচারিতা। রাষ্ট্রের জনসাধারণ যখন চরম দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করে তখন রাজা কিন্তু চরম আয়েশি বিলাসী জীবন যাপন করেন। রাজা সহ তার প্রত্যেক রাণীর জন্য রয়েছে আলাদা আলাদা বিলাস বহুল বাড়ি, গাড়ি অসংখ্য চাকর-চাকরানী। রাজা চলাচলের জন্য ক্রয় করেছেন সাড়ে চার কোটি ডলার দামের একটি প্রাইভেট জেট বিমান। মাঝে মাঝে রাণীরা এই বিমানে চড়ে বাইরের দেশে মার্কেটিং করতে যান।

জনগণের দাবিকে উপেক্ষা করে দেশের কথা চিন্তা না করে নিজস্ব অনৈতিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন রাজা এমস্বোয়াতি। এসব বিকৃত চিন্তার জন্যই আফ্রিকার লোকজন তাকে উলঙ্গ রাজা বলে ডাকে। এতকিছুর পরও সোয়াজিল্যান্ডের জনগণ তাদের রাজাকে খুব ভালবাসেন। তারা মনে করেন রাজা তাদের কাছে ঈশ্বরের উপহার। তবে আজকাল জনগণ তার কিছু পদক্ষেপের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ জানাচ্ছে এবং গণতন্ত্রের দাবীও জানাচ্ছে।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.