Header Ads

মেক্সিকোর উড়ন্ত মানুষের শহর !

পাখি আকাশে উড়ে। এখন যদি আপনাকে বলি মানুষ আকাশে উড়ে তাহলে কি আপনি অবাক হবেন? হয়তো হবেন না, কারণ আজকাল মানুষ বিমানে চড়ে পাখির চেয়ে শত গুণ দ্রুত বেগে উড়তে পারে। তবে যদি বলি মানুষ বিমান ছাড়াই আকাশে উড়ে তাহলে কি অবাক হবেন না? আপনি অবাক হোন আর নাই হোন এমন এক জায়গা আছে যেখানের কিছু মানুষ আকাশে উড়ে বেড়ায়। মেক্সিকোর দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের সাধারণ একটি শহর। শহরটির নাম গুতিয়েরেজ জামোরা।

আর শহরেই বাস করে কিছু 'উড়ন্ত মানুষ' তার অর্থ কিন্তু এই নয় যে, এখানের মানুষেরা সত্যি সত্যি পাখির মতো ডানা মেলে আকাশে উড়ে বেড়ায়। আসল কথা হলো প্রতিবছর এখানে যখন স্থানীয় মেলা বসে তখন অদ্ভুত এক খেলার আসর বসে সেই মেলায়। আর সেই খেলায় উড়ে বেড়ানোর মতো কৌশল দেখায় কিছু মানুষ। এদেরকেই উড়ন্ত মানুষেরা বলা হয়। সেই উড়ন্ত মানুষদের খেলা দেখার জন্য চারদিক থেকে অনেক লোক এসে জড়ো হয় সেখানে। তবে এটিকে খেলা না বলে রোমহর্ষক ধর্মীয় আচার বলাই ভাল। কারণ বহুকাল আগে কেবল ধর্মীয় উদ্দেশ্যেই এরকম রোহমর্ষক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো।

চৈত্র সংক্রান্তিতে আমাদের দেশে যেমন গাজনের মেলায় চড়ক গাছের যে ভয়াবহ চক্কর দেখা যায়, এই খেলাটিও অনেকটা সেরকম। খুঁটিতে ঘুরপাক খাওয়া এই উড়ন্ত মানুষদের স্থানীয় ভাষায় বলা হয় ভোলাডোর। স্প্যানিশ ভাষায় ভোলাডোর মানে হচ্ছে শূন্যে উড়ন্ত অবস্থায় বিচরণকারী।

এই উড়ন্ত মানুষেরা কিন্তু সাধারণ উচ্চতায় উড়ে বেড়ায় না। মাটি থেকে একটা ধাতব খুঁটির উচ্চতায় তারা খেলা দেখায়। যেটি রীতিমতো দশ তলা দালানের সমান। আর এই খুঁটিকে কেন্দ্র করেই তারা উড়ে বেড়ায়, আর ঝুলে থাকার অসম্ভব কসরত দেখায় ভোলাডররা। তাদের পরনে থাকে পালক শোভিত উৎসবের পোশাক। ভোলাডোররা যখন খুঁটির হুক বেয়ে এর মাথায় গিয়ে পৌঁছে তখন এদের একেবারে পুতুলের মতো দেখায়, তাদের শ্বাসরুদ্ধকর কসরত প্রদর্শনের জন্য প্রথানুযায়ী পাঁচজন ভোলাডোর উঠে সুদীর্ঘ খুঁটির শীর্ষে। খুঁটির মাথায় থাকে একটা বর্গাকার ফ্রেম। ফ্রেমের ভেতর খুঁটি সংলগ্ন থাকে বড়সড় একটা লাটাই।

ভোলাডোররা খুঁটির মাথায় পৌঁছে প্রথম যার যার কোমরে বাঁধা মোটা রশির আরেক প্রান্ত পেঁচাতে শুরু করে এই লাটাইয়ে। পাঁচজনের একজন দলপতি হিসেবে বসে থাকে খুঁটির মাথায়। সেই মূলত কসরতের নিয়ন্ত্রক। বাকি চারজন যার যার কোমরের রশির ওপর ভর করে আলতো ড্রাইভ দিয়ে ঝুলে পড়ে মাথা নিচের দিকে রেখে। চার ভোলাডোরের জন্য যার যার কোমরে বাঁধা রশি লাইফ লাইন হিসেবে কাজ করে। তারা এমন ঝুঁকির মধ্যে এই কাজ করে যে, রশির মাথা ছুটে গেলেই দশ তলার সমান উঁচু থেকে পড়ে নির্ঘাত মৃত্যু। কোমরে বাঁধা রশির ওপর ভর করে ভোলাডোররা শূন্যে ঝুলে পড়লে তাদের উড়ন্ত কসরত প্রদর্শনের প্রস্তুতি সারা হয়ে যায়।

উপরে যখন উড়ন্ত মানুষেরা কসরত প্রদর্শন করে তখন নিচে ভয় আর আতংক নিয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে থাকে নীরব হাজারো দর্শক। তারা শ্বাসরুদ্ধকর এক সময় অতিবাহিত করে প্রদর্শনী দেখার সময়। বলতে গেলে এটি একই সঙ্গে বিস্ময়কর এবং বিপজ্জনক এক উড়ন্ত নাচ। এই উড়ন্ত নাচের পারফরমার মূলত টোটোনাক ইন্ডিয়ানরা। শত শত বছর ধরে এই ঐতিহ্যবাহী প্রদর্শনী চালিয়ে আসছে তারা।

এক সময় ভোলাডোররা উড়ন্ত নাচের এই প্রদর্শনী করত ধর্মীয় কারণে। সূর্যদেবের তুষ্টির জন্য বিশেষ উৎসবের আয়োজন হতো এই প্রদর্শনীর। এখন টোটোনাকরা সবাই রোমান ক্যাথলিক। কিন্তু নিজেদের প্রাচীন ঐতিহ্যকে এরা সযত্নে আঁকড়ে রেখেছে এখনো। বর্তমানে বিভিন্ন মেলা এবং ভোজ উৎসবে ভোলাডোর নামের উড়ন্ত মানবরা দেখায় তাদের ঘূর্ণি নাচ। ভোলাডোর হওয়া বিরাট এক গৌরবের ব্যাপার। টোটোনাক ছোটরাও কসরত শিখে থাকে বড়দের দেখে দেখে এবং প্রদর্শনীতে তাদের নানাভাবে সাহায্য করে। প্রদর্শনীর শুরুতে ধাতব খুঁটির মাথায় যে ভোলাডোর থাকে, সে প্রথমে বাঁশি বাজায় এবং ঐতিহ্যবাহী ছন্দ তোলে ছোট এক ঢোল বাজিয়ে। ঢোলের ছন্দের তালে তালে পা নেড়ে নেড়ে নাচ। তারপর ওই ভোলাডোর বসে গেলে শুরু হয় প্রদর্শনীর আসল মিউজিক।

সহসা চার ভোলাডোর উড়ার ভঙ্গিতে শূন্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে। খুঁটির ফ্রেম এবং লাটাই ঘুরতে শুরু করে তখন। ঝুলন্ত ভোলাডোরদের ভারে পাক খুলতে থাকে লাটাইয়ে জড়ানো মোটা রশিগুলোর। ভোলাডোররা রশিতে পা পেঁচিয়ে মাথাটা নিচের দিকে রেখে ঘুরতে থাকে চরকির মতো। সময় তারা উড়ন্ত পাখির মতো হাত দুটো ছড়িয়ে দেয় শূন্যে। চরকির ঘূর্ণন যত বাড়তে থাকে, ততই বৃত্তাকারে ছড়িয়ে পড়তে থাকে ভোলাডোররা। এভাবে দড়ির সম্পূর্ণ পাক খুলতে মিনিট তিনেকের মতো সময় লাগে। মাটির ঠিক কাছাকাছি পৌঁছে আঘাত লাগার আগেই দক্ষ কৌশলে নেমে পড়ে তারা। এই অদ্ভুত খেলার জন্য বিশ্বজুড়ে এই শহর টোটোনাকরা সমধিক সমাদৃত।

উড়ন্ত মানুষদের এই খেলায় ভয় প্রবল ঝুঁকি থাকলেও তারা আজও তাদের ঐতিহ্যকে ধরে রেখে প্রতিবছর এই খেলা করে যাচ্ছে। এই খেলা দেখাতে গিয়ে কেউ আহত হয় না এমনটি নয়, তারপরও এটি তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি সভ্যতার পরিচায়ক।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.