Header Ads

সৌভাগ্যের চিরঞ্জীব ফিনিক্স পাখির গল্প

বিশ্বজুড়ে দেশে দেশে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের পৌরাণিক কাহিনী। এই সকল পৌরাণিক কাহিনীকে অনেকে বিশ্বাস করে থাকেন আবার অনেকে বিশ্বাস করেন না। এই সকল পৌরাণিক কাহিনীর মধ্যে ফিনিক্স পাখির কাহিনী অন্যতম। পাখি অন্যান্য সকল জীবের মতোই একটি জীব। আর জীব মাত্রই তার মৃত্যু আছে। তবে যদি বলা হয় চিরঞ্জীব পাখি, তবে বিষয়টি খুবই হাস্যকর মনে হবে। হাস্যকর হোক আর যাহাই হোক তারপরও সত্যি যে, অনেকেই বিশ্বাস করেন যে ফিনিক্স পাখি চিরঞ্জীব। শুধু চিরঞ্জীব নয় ফিনিক্স পাখির সম্পর্কে দেশে দেশে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের কাহিনী। এই পাখি চিরঞ্জীব, উপকারী, শক্তিধর সহ নানান গুনের কীর্তি রয়েছে এই পাখির নামে। আসুন আমরা এই সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি।


পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে পবিত্র অনল প্রভা থেকে ফিনিক্স পাখির সৃষ্টি। ফিনিসীয় পুরাণ, চাইনিজ পুরাণ, গ্রিক পুরাণ এবং প্রাচীন মিসরীয়দের বর্ণনায়ও ফিনিক্স পাখির উল্লেখ পাওয়া গেছে। প্রাচীন গ্রিক পুরাণ অনুসারে ফিনিক্স হলো এক পবিত্র 'অগ্নি পাখি' আর এটি এমনই পবিত্র আগুন পাখি, যার জীবনচক্র আবর্তিত হয় হাজার বছর ধরে। মনোলোভা স্বর্ণের লেজ এবং লাল, গোলাপি নীল রঙের পালক দ্বারা আবৃত ময়ূর সদৃশ এই পাখির প্রকৃত অর্থে কোনও মৃত্যু নেই। হাজার বছর নির্বিঘ্নে বেঁচে থাকতে পারে এরা।

যমদূত আসার ঠিক আগেই ফিনিক্স পাখি নিজের বাসা নিজেই আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। আর নির্মমভাবে দগ্ধীভূত এই পাখি তার বাসার ভস্ম থেকেই জন্ম নেয় নতুন ডিম। প্রাণ পায় নতুন জীবনের, শুরু হয় আবারও জাতিশ্বর ফিনিক্সের অবিনাশী যাত্রা। বেঁচে থাকে আগের জনমের আয়ুষ্কালের মতোই। প্রচলিত লোককাহিনী মতে, ফিনিক্স পাখিকে হিংসুকেরা আঘাত করলে এর পালক থেকেও জন্ম নেয় নতুন প্রাণ। এদের চোখের পানিও বদলে দিতে পারে কারও জীবন। আগুন পবিত্রতার বদৌলতে এরা মৃত্যু পথযাত্রীদেরও সাময়িক জীবন দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।

অন্য কাহিনী অনুযায়ী ফিনিক্স পাখির পুড়ে যাওয়া ছাই ডিমের আকারে মমি করে মিসরের সূর্য শহর কিংবা গ্রিসের দ্য সিটি অব সান- রেখে দেওয়া হয়েছিল। একদিন ওই ছাইয়ের ডিম থেকেই পাখিটি পুনর্জন্ম লাভ করে এবং দেব পাখির প্রতীক হয়ে যায় গ্রিকদের কাছে। ফিনিক্স পাখি খ্রিস্টানদের শিল্পকলা, সাহিত্য প্রতীক বাদে খুব দ্রুত পুনরুত্থিত হয় এবং তা খুব জনপ্রিয়ও হয়।


খ্রিস্টানরা তাকে তাদের পুনরুত্থান, অমরত্ব মৃত্যুর পর জীবিত হওয়ার প্রতীকও মনে করতে থাকে। এই গ্রিক ফিনিক্স পাখি পরবর্তী সময়ে পৃথিবীর অনেক সভ্যতায় ঐশ্বরিক প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। মিসরীয়রা ফিনিক্সকে বক জাতীয় পাখি মনে করে একে ডাকত বেন্নু পাখি বলে। বেন্নুকে বলা হয় সূর্য দেবটা 'রা' এর আত্মা। পরবর্তী সময়ে রোমান চিত্রকলায় ফিনিক্স ঈগল রূপে প্রতিষ্ঠা পায়।

পারস্যের লোককাহিনী অনুযায়ী মহাবীর রুস্তমের বাবা জাল এই প্রতীক পাখিকে সযত্নে লালন করেছিলেন। গৃহহীন এই পাখিকে তিনি পেয়েছিলেন আলব্রুজ পাহাড়ে। লেবানন তাদের প্রাচীন এবং আধুনিক সংস্কৃতির প্রধান বাহক মনে করে ফিনিক্সকে। লেবানন বৈরুতের ইতিহাসে এই প্রতীকের ভাস্কর্য সাতবার ধ্বংস পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। ফিনিসীয় সভ্যতায় ফিনিক্সের আবাসস্থল থাকত কোনও ঝরনা বা কূপের পাশে। ভোরে গোসল করার সময় ফিনিক্সের গাওয়া গান শোনার জন্য গ্রিক সূর্য দেবতা হেলিয়োস রথ থামাত। অমরত্ব আর পুনরুজ্জীবনের প্রতীক ফিনিক্স মৃত্যুর আগে হেলিওপোলিসে গমন করত।

চীনে লোক কাহিনীর প্রাণী ড্রাগনের পরই ফিনিক্সের স্থান। চীনের কিংবদন্তিতে ফিনিক্স হচ্ছে এক ধরনের উপকারী পাখি। চীনারা 'সোনালি ফিনিক্সকেপ্রতিকূল পরিবেশে বড় হওয়া সেরা ধীশক্তির উপমা হিসেবে ব্যবহার করে। চীনের ক্যারাতে দো এসোসিয়েশন এবং বিভিন্ন দেশের প্রতিষ্ঠান ফিনিক্স পাখির লোগো ব্যবহার করে। আর তা ব্যবহার করা হয় এই বিশ্বাসে যে, আমরাও ফিনিক্স পাখির মতো পুনরায় জন্মলাভ করতে চাই। এছাড়া চাইনিজ এবং জাপানিজ ঐতিহ্যে ফেংহুয়াং পাখিকে ফিনিক্সের কাছাকাছি ধরা হয়। চীনের বেইজিং শহরে ফিনিক্সের স্ট্যাচু এখনো সম্মানের প্রতীক হয়ে আছে। এটিকে চীনের পাখিদের নেতাও বলা হয়। জাপানে ফিনিক্সকে ডাকা হয় অমরত্বের পাখি হিসেবে। বর্তমান সময়ে অনেকে নিজের শরীরের বিভিন্ন অংশে ফিনিক্স পাখির ট্যাটু আঁকিয়ে রাখে সৌভাগ্যের আশায়।

ফিনিক্সের মনোমুগ্ধকর পালক গুচ্ছ বর্ণময় উজ্জ্বল। অধিকাংশ বর্ণনা মতে লাল, গোলাপি নীল রঙের পালক দ্বারা আবৃত এই পাখিটি অনেকটা ময়ূর সদৃশ। এর পুচ্ছ-পাখনা রক্তচন্দন বা লাল মুনিয়ার মতো। ফরাসি সাহিত্যিক দার্শনিক ভলতেয়ার ফিনিক্সের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে 'ফিনিক্সের আকৃতি ঈগলের মতো বিশাল কিন্তু চোখগুলো নিষ্ঠুর ভীতিকর নয়, নির্দয় ঈগলের তুলনায় নিরীহ সংবেদনশীল। ঠোঁট গুলো গোলাপের মতো। গ্রীবা ঘাড় রংধনু সদৃশ বা এর থেকেও দীপ্তিমান। পালক গুচ্ছে খেলা করে স্বর্ণালী ছায়াচ্ছন্নতা। বেগুনি-লাল বা রুপালি তার পদযুগল'

এভাবে পৃথিবীর দেশে দেশে পৌরাণিক পাখি ধর্মীয় সংস্কৃতির প্রতীক হিসেবে নানাভাবে ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে। এছাড়া রাশিয়া, তাইওয়ানসহ আরও অনেক দেশের লোককাহিনী বা ধর্মীয় বিষয়াদিতে পাখির সন্ধান পাওয়া যায়। কিংবদন্তিতে আরও বলা হয়েছে, ফিনিক্স যখন মানুষের দুঃখ-কষ্ট দেখে তখন তার চোখ থেকেও জল গড়ায়, আর তার স্পর্শে মানুষ হয়ে ওঠে মৃত্যুঞ্জয়ী। আর কারণেই জনপ্রিয় শহুরে সভ্যতা, কৃষ্টি সংস্কৃতিতে একটি ফিনিক্স স্থায়ী রূপকার্থক প্রতীক।

ফিনিক্স পাখি সত্যিই আছে কিনা সেটা এখনও যুক্তি-তর্কের বিষয়। সেটি যদি সত্যি থেকেই থাকে তবে পৌরাণিক কাহিনী ফিরে আসতে পারে সত্যি রূপে নতুবা এটি সত্যিই একটি পৌরাণিক কাহিনী হিসেবেই বেচে থাকবে বছরের পর বছর ধরে।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.