সাতক্ষীরার দর্শনীয় নলতা শরীফ
বাংলাদেশ একটি মুসলিম অধ্যুষিত দেশ। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ধর্ম ইসলাম। যুগে যুগে এদেশে জন্ম লাভ করেছে অনেক পীর, মাশায়েখ ও বুজুর্গ ব্যক্তি। ইসলাম প্রচার ও ধর্মের টানে এদেশে আগমন করেছে অনেক ধর্মীয় পুরুষ। যাদের পরিশ্রমে ইসলামের পতাকা উড্ডীন হয়েছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশে সমাজ সংস্কার ও ইসলাম প্রচারের জন্য যে সকল ব্যক্তি তাদের প্রচেষ্টা ব্যয় করেছেন তার মধ্যে খান বাহাদুর আহসান উল্লাহ অন্যতম। তিনি সাতক্ষীরা তথা বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত ব্যক্তি। তার ওফাতের পর তার নাম অনুসারে সাতক্ষীরা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে নানান প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। তার স্মৃতি ধন্য সাতক্ষীরার নলতা শরীফ বর্তমানে একটি দর্শনীয় স্থান।
সাতক্ষীরা
জেলার অন্যতম একটি উপজেলা কালীগঞ্জ। এ উপজেলারই একটি
গ্রাম নলতা। শান্ত, শ্যামল ও সৌম্য এ
গ্রামটি আজ দেশ-বিদেশে
ব্যাপকভাবে পরিচিত। এ গ্রামেই জন্মেছিলেন
খান বাহাদুর আহসান উল্লাহ। বাংলাদেশের অবহেলিত-অশিক্ষিত বাঙালি মুসলমান যুবকদের মধ্যে তিনি শিক্ষা বিস্তারে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে গেছেন। তিনি তার সারাটি জীবন ব্যয় করেছেন মানুষের কল্যাণে। বাংলাদেশের বিখ্যাত আহছানিয়া মিশনের প্রতিষ্ঠাতা এই খান বাহাদুর
আহসান উল্লাহ।
খান
বাহাদুর আহসান উল্লাহ ১৮৭৩ সালের ডিসেম্বর মাসে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম
পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মুন্সী মোহাম্মদ মুফিজ উদ্দিন এবং মায়ের নাম মোছা: আমিনা বেগম। স্থানীয় স্কুলে লেখাপড়া শেষে আহসান উল্লাহ উচ্চ শিক্ষার জন্য কলকাতা যান এবং ১৮৯৫ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে দর্শনে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ছিলেন রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের প্রথম মুসলিম প্রধান শিক্ষক। তিনিই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি ব্রিটিশ সরকারের অধীনে অবিভক্ত বাংলার শিক্ষা বিভাগে একজন মুসলমান হিসেবে যোগ দেন এবং সহকারী ডিরেক্টর পদ পর্যন্ত অলঙ্কৃত
করেন। এছাড়াও তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সিনেটর ছিলেন।
সরকারি
কাজে নিযুক্ত থাকার সময় তিনি বিভিন্ন জেলা ও বিভাগে কাজ
করেন। এসব স্থানে চাকরি করার সময় তার বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়। তিনি লক্ষ্য করেন, অবিভক্ত বাংলার শিক্ষকগণ অধিকাংশ হিন্দু হওয়ায় তারা মুসলমান ছাত্রদের পরীক্ষায় নম্বর কম দিত। ফলে
মেধাবী মুসলমান ছাত্ররা প্রবেশিকা পরীক্ষায় ভালো ফল করতে না
পেরে উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তিনি অনুসন্ধান করে দেখেন পরীক্ষার খাতায় পরীক্ষার্থীর নাম থাকার কারণেই এ সমস্যা হচ্ছে।
তাই
তিনিই সর্বপ্রথম পরীক্ষার খাতায় পরীক্ষার্থীর নাম লেখার রীতি বিলোপ করে শুধু রোল নম্বর লেখার রীতি প্রচলন করেন। এ রীতি প্রচলিত
হলে পরীক্ষকদের পক্ষপাতিত্বের সুযোগ থাকে না। তিনি মাদ্রাসার পাঠ্যসূচিও যুগোপযোগী করেন এবং মাদ্রাসা পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের উচ্চ শিক্ষার পথ উন্মুক্ত করেন।
খান বাহাদুর আহসান উল্লাহ স্বীয় চেষ্টায় উচ্চশিক্ষা লাভ করেন এবং বাঙালি মুসলমান যুবকদের জন্য উচ্চশিক্ষার পথ প্রশস্ত করে
যান। তিনি অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। তিনি বাংলা একাডেমীর প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য ছিলেন। শিক্ষা বিস্তারে তার অসাধারণ ভূমিকার জন্য তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার তাকে খান বাহাদুর উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯২৯ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়ে তিনি এক বিরাট কর্মযজ্ঞে
ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি ১৯৩৫ সালে সাতক্ষীরার নলতায় 'স্রষ্টার ইবাদত ও সৃষ্টির সেবা
এই আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রতিষ্ঠা করেন আহছানিয়া মিশন। ১৯৬৪ সালে এর শাখা প্রতিষ্ঠা
করেন ঢাকায়। প্রতিষ্ঠানটি আজ নিজ গুণে
দেশ-বিদেশে ব্যাপক সুনাম অর্জন করেছে। এ প্রতিষ্ঠান থেকে
এখন আরও বহু সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়েছে।খান বাহাদুর আহসানুল্লাহ
দিন
দিন এর প্রসার ঘটছে।
এদেশের আর্থ-সামাজিক ও শিক্ষা ক্ষেত্রে
নীরবে অবদান রেখে চলেছে আহছানিয়া মিশন। খান বাহাদুর আহসান উল্লাহর চরিত্রে বহুগুণের সমন্বয় ঘটেছিল। তিনি একাধারে ছিলেন শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারক,
সু-সাহিত্যিক, বাংলা ভাষার গভীর অনুরাগী, মানব সেবক ও ইসলামী চিন্তাবিদ।
নারী জাতি ও অন্য সম্প্রদায়ের
মানুষের প্রতি তার ছিল গভীর শ্রদ্ধাবোধ। তিনি জাগতিক কাজের পাশাপাশি ইহলৌকিক কাজেও জীবনের বহু সময় ব্যয় করেছেন। জীবনের শেষ দিকে তিনি কামেল পীর হিসেবে পরিচিত হন, তার সিদ্ধ জীবনের পরিচয় পেয়ে বহু মানুষ তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তার বহু হিন্দু ভক্তও দেখা যায়।
১৯৬৫
সালের ৯ ফেব্রুয়ারি এই
কর্মবীর সাধক ইহজগৎ ত্যাগ করেন। তাকে তার জন্মস্থান নলতায় সমাহিত করা হয়। পরে তার সমাধিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে আজকের খান বাহাদুর আহসান উল্লাহ সমাধি কমপ্লেক্স বা নলতা শরীফ।
প্রায় ৪০ বিঘা জমির
ওপর গড়ে ওঠা এই কমপ্লেক্সের মধ্যে
আছে মাজার, মসজিদ, অফিস, লাইব্রেরি, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, অতিথিশালা, পুকুর ও বেশকিছু উন্মুক্ত
জায়গা। একটি উঁচু মাটির ঢিবির মতো দেখতে, যার চারদিকের ঢালে রয়েছে নজর কাড়া ফুলের বাগান। এ বাগানের শীর্ষে
রয়েছে একটি দৃষ্টিনন্দন সমাধিসৌধ। এর নির্মাণশৈলী ও
নির্মাণ উপকরণ অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও মূল্যবান। সমাধিসৌধে
ওঠার জন্য তিন দিকে ৩টি সিঁড়ি রয়েছে।
তবে
দক্ষিণের সিঁড়িটি বেশ প্রশস্ত এবং আকর্ষণীয়। মোট ৯টি গম্বুজ দ্বারা সৌধটি সুশোভিত করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় গম্বুজটি বেশ বড় এবং দর্শনীয়।
খান বাহাদুর আহসান উল্লাহ মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে এই সমাধিকে কেন্দ্র
করে প্রতিবছর ৮, ৯ ও
১০ ফেব্রুয়ারি এখানে বার্ষিক ওরস মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। তখন ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার ভক্ত-অনুরাগীরা ছুটে আসে নলতা শরীফে।
ওরজের
তৃতীয় দিন শেষে ওরজে আগতদের খাবার দেওয়ার মাধ্যমে ওরজ সমাপ্ত করা হয়। এই ওরজ উপলক্ষে
নলতায় মেলাও বসে। যেখানে দেশ-বিদেশের হরেক রকম জিনিস বিক্রয় করা হয়। বর্তমানে নলতা শরীফ সাতক্ষীরা তথা বাংলাদেশের একটি দর্শনীয় স্থান।
কোন মন্তব্য নেই