খ্রিস্ট শিশুদের বন্ধু সান্তা ক্লজের পরিচয়
২৫ ডিসেম্বর শুভ বড় দিন বা হ্যাপি ক্রিসমাস। খ্রিষ্টানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। বিশ্ব খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীরা আনন্দ উৎসব আর ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে এই দিনটি উদযাপন করে থাকে। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া সহ প্রভৃতি দেশে এই দিবসটি খুবই আনন্দ উচ্ছ্বাসের মধ্য দিয়ে উদযাপন করা হয়। বড় দিনের উৎসব আরও বেশী আনন্দময় ও শুভময় হয়ে উঠে বিশেষ একজন ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে। হ্যাঁ, সেই ব্যক্তিটি হচ্ছেন সান্তা ক্লজ।
আগের
দিন বাচ্চারা সান্তার জন্য দুধের গ্লাস, প্লেট ভর্তি কুকি সাজিয়ে অপেক্ষা করতে করতে এক সময় ক্লান্ত
হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। পরদিন সকালে উঠেই দৌড়ে ক্রিসমাস ট্রির নিচে যায়, গিয়ে দেখে সান্তা তাদের জন্য উপহার রেখে গেছে কিনা। এরপর বাচ্চারা কিচেনে যায় খোঁজ করতে যে, তাদের রেখে দেওয়া দুধ আর কুকি সান্তা
খেয়েছে কিনা। তারা খুশিতে আটখানা হয়ে যায় যখন দেখে সান্তা ক্লজ তাদের রেখে দেওয়া দুধ ও কুকির সবটুকুই
খেয়েছে। তারা তখন আরেকবার আনন্দের সাথে হেসে ভাবে, পৃথিবীতে সান্তা ক্লজই হচ্ছে তাদের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু।
সান্তা
ক্লজ কে এই সম্পর্কে
আমরা অনেকেই জানি আবার অনেকেই জানি না। সদা আনন্দময় এই ব্যক্তিটি সম্পর্কে
সবার মাঝে বিশেষ কৌতূহল রয়েছে। আমরা সাধারণভাবে ধারণা করি সান্তা ক্লজ হচ্ছে খুবই মোটাসোটা এক বুড়ো, যার
মুখ ভর্তি সাদা দাড়িগোঁফ, যে কিনা টকটকে
লাল রংয়ের কোট, লাল রংয়ের প্যান্ট, সঙ্গে কোমরে চওড়া কালো বেল্ট, কালো বুটজুতো, মাথায় লাল টুপি পরে ঘুরে বেড়ায়। সান্তা ক্লজ সম্পর্কে আমরা যারা জানি না আসুন আজকে
আমরা জানার চেষ্টা করি।
সান্টা
ক্লজ সম্পর্কে ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, কয়েকশ বছর আগে সেইন্ট নিকোলাস নামের এক প্রিস্ট ছিলেন।
তিনি খুবই দয়ালু ছিলেন। তার জন্ম হয়েছিল আধুনিক তুরস্কের নিকটবর্তী 'পাতারা' নামক কোনও এক গ্রামে। কথিত
আছে, সেইন্ট নিকোলাস উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সব সম্পত্তি গরিব-দুঃখীদের মাঝে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। সেইন্ট নিকোলাস এক জায়গা থেকে
আরেক জায়গা, এক দেশ থেকে
আরেক দেশ চষে বেড়াতেন, যেখানেই কাউকে দুস্থ দেখতেন অথবা কাউকে বিপদগ্রস্ত দেখতেন, তিনি সাহায্য করতেন।
এক
সময় সারা ইউরোপে তার নামে জয়জয়কার শুরু হতে থাকে এবং তার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে থাকে। সেইন্ট নিকোলাস পরিচিতি পেতে থাকেন বাচ্চাদের পরম বন্ধু ও সবার দুর্দিনের
সাথী হিসেবে। এভাবেই একসময় সেইন্ট নিকোলাস সারা ইউরোপে সবচেয়ে জনপ্রিয় সেইন্ট হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন। নিকোলাসের মৃত্যুর পর তার মৃত্যু
দিনটি অর্থাৎ
৬ ডিসেম্বর দিনটি একটি শুভদিন হিসেবে পালন শুরু হয়। তার অনুসারীরা এই দিনটিকে সেইন্ট
নিকোলাসের স্মরণে উদযাপন করা শুরু করে। আমেরিকান কালচারে সেইন্ট নিকোলাসের অন্তর্ভুক্তি হয় ১৮০০ শতকের
শেষে অর্থাৎ ১৭৭৩-১৭৭৪ সালের দিকে। নিউইয়র্ক পত্রিকায়ই প্রথম প্রকাশিত হয় একদল ডাচ
ফ্যামিলি সেইন্ট নিকোলাসের মৃত্যুবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে সমবেত হওয়ার কথা।
প্রকাশিত
হয় 'সান্তা ক্লজ' নামকরণের ইতিহাস। সান্টা ক্লজ নামটি এসেছে নিকোলাসের ডাচ নাম সিন্টার ক্লাস থেকে। ১৮০৪ সালে নিউইয়র্ক হিস্টোরিক্যাল সোসাইটির সদস্য জন পিনটারড সোসাইটির
বার্ষিক সম্মেলনে উপস্থিত সবাইকেই সেইন্ট নিকোলাসের ইমেজ সম্বলিত কাঠের তৈরি একটি ছবি দিয়েছিলেন। আধুনিক সান্টার ফিচারের সঙ্গে সেইন্ট নিকোলাসের সেই ইমেজের খুবই মিল ছিল। ধীরে ধীরে সেইন্ট নিকোলাস থেকে সান্তা ক্লজ নামেই নিকোলাস আমেরিকান সমাজে প্রতিষ্ঠা পেতে শুরু করেন।
১৮০৯
সালে বিখ্যাত লেখক ওয়াশিংটন আরভিং তার লেখা বই 'নিউইয়র্কের ইতিহাস'-এ সিন্টার ক্লাসকে
নিয়ে গল্প লেখেন, যা পরবর্তীতে 'সান্তা
ক্লজ'কে আমেরিকায় জনপ্রিয়
হতে সাহায্য করে। যুক্তরাজ্য ও ইউরোপে সান্টাক্লজের
রূপটি আমেরিকান সান্টার মতো হলেও এই অঞ্চলে তিনি
ফাদার খ্রিষ্টমাস নামেই সমধিক পরিচিত। ১৮২২ সালে বিশপ ক্লিমেন্ট ক্লার্ক মুর তার তিন কন্যার উদ্দেশে একটি কবিতা লিখেন, ' ভিজিট ফ্রম সেইন্ট নিকোলাস' নামের কবিতাটিতে তিনি বলতে চেয়েছিলেন প্রতি ক্রিসমাস ইভনিং এ নর্থ পোল
থেকে খুবই আমুদে এক বামন বুড়ো
আসে লক্ষ্মী বাচ্চাদের জন্য ঝোলা ভর্তি উপহার নিয়ে।
তার
পরনে থাকে লাল ওভারকোট, লাল প্যান্ট, কালো বুটজুতো, কালো চওড়া বেল্ট কোমরে বাঁধা, মাথায় লাল টুপি ও মুখ ভর্তি
সাদা দাড়িগোঁফ। তার সঙ্গে থাকে আটটি রেইন ডিয়ার, তাদের পিঠে চড়ে বুড়ো এসে বাড়ির ছাদের চিমনি দিয়ে ঘরে ঢুকে বাচ্চাদের গিফট দেয়। বুড়ো সবসময় হো হো হো
করে হাসতেই থাকে। বুড়ো এতদূর থেকে আসে বলে তার খিদেও পেয়ে যায়। তাই তার জন্য দুধ আর কুকি রেখে
দিতে হয়।
এভাবেই
ঊনিশ শতকের গোঁড়ার দিকে ক্রিসমাস উপলক্ষে উপহার বিনিময় এক ধরনের সামাজিক
প্রথায় রূপান্তরিত হতে থাকে। বিশেষ করে বাচ্চাদের জন্য উপহার কেনা হয়ে উঠে এক ধরনের নির্মল
আনন্দের বিষয়। আর এই উপহার
বিনিময় সংস্কৃতিকে আমেরিকান সমাজে প্রতিষ্ঠা দিতে অবশ্যই ব্যবসায়ী শ্রেণীর ভূমিকাই ছিল প্রধান। এভাবেই খ্রিস্ট ধর্মে সান্তা ক্লজ নামে এক ব্যক্তির সূচনা
হয় এবং সেই থেকেই আজ পর্যন্ত প্রতি
বড় দিনের উৎসবে সান্তা ক্লজ বিশেষ স্থান দখল করে থাকে।
শিশুরা
এখন প্রতিবছর বড় দিনের উৎসবের
জন্য অপেক্ষায় থাকে শুধুমাত্র সান্তা ক্লজের কারণে। সান্তা ক্লজকে খুশি করার জন্য এবং তাকে খাওয়ানোর জন্য বড় দিনের এই
দিনে বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি টাকার বাঁশি, কুকি, কেক, টুপি ইত্যাদি বিক্রি হয়। বর্তমানে বড় দিনের উৎসবে
দেখা যায় একজন বয়স্ক ব্যক্তি সান্তা ক্লজের পোশাক পরে সান্তা ক্লজ সাজেন এবং শিশুদের আনন্দ দেন। শিশুদের কাছে বর্তমানে সান্তা ক্লজ এক বিনোদনের নাম।
সান্তা
ক্লজ বিষয়টি পুরোপুরি মিথ্যা হওয়ার কারণে অনেক খ্রিস্টানও এর বিরোধিতা করে
থাকেন। অনেকেই বলেন, ছোট শিশুদের শৈশব থেকেই সান্তা ক্লজের মাধ্যমে মিথ্যা শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে যেটা বড় ধরনের অপরাধ।
এছাড়াও সান্তা ক্লজকে কেন্দ্র করে জড়িয়ে রয়েছে একটি ব্যবসায়িক স্বার্থ, সে জন্য অনেকে
মনে করেন সান্তা ক্লজ নামক বিষয়টি সবার পরিত্যাগ করা উচিৎ।
কোন মন্তব্য নেই