কুসংস্কার দেশে দেশে (পর্ব ৩)
বিশ্বে কুসংস্কার নেই এমন কোনও দেশ বা সমাজ নেই। প্রত্যেক দেশ ও সমাজে হাজার হাজার বছর ধরে কুসংস্কার দানা বেধে আছে। কুসংস্কার গুলো মূলত লোক মুখে প্রচলিত হয়ে সমাজে বসবাস করে। কুসংস্কারের বিষয়গুলো মিথ্যা হলেও এগুলো সমাজ থেকে সহজে উৎখাত হয় না। কারণ এগুলো লোক মুখে সহজে প্রচারিত হয় এক স্থান থেকে অন্য স্থানে। বর্তমান আধুনিক সভ্যতায় কুসংস্কারকে মোচন করার চেষ্টা করা হলেও তা অনেকাংশে সফল হচ্ছে না। কারণ, কুসংস্কার মানব সমাজে মানবীয় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গত
দুই পর্বে আমরা বিশ্বের নানান কুসংস্কারের বিষয়ে আলোচনা করেছি। আজ আমরা এর
তৃতীয় পর্বে আরও বেশ কিছু কুসংস্কার সম্পর্কে আলোচনা করবো।
ক্রীড়া জগত:
সাংস্কৃতিক
এবং ক্রীড়া জগতের মানুষ আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি পরিচিত। মজার ব্যাপার হলো এদের অনেকের মধ্যেই কুসংস্কারের প্রবল প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এরকম বিখ্যাত আর পাবলিক আইকন
হওয়ার পরও তারা কুসংস্কার থেকে দূরে থাকতে পারে না। দেখা যায়, জনপ্রিয় অনেক শিল্পী বিশেষ এক রংয়ের পোশাক
ছাড়া মঞ্চেই ওঠেন না। অনেক খেলোয়াড় খেলার মাঠে নামার আগে সব সময় ডান
কিংবা বাঁ পা আগে বাড়ান,
কিংবা কোনও তারকা ক্রিকেটার নির্দিষ্ট কোনও ব্যাট বা গ্লাভস ছাড়া
খেলতেই পারেন না। কোনও খেলোয়াড় মাঠে নামার আগে মাটিতে হাত দ্বারা চুমো খান, অনেকে খেলার বলে চুমো খান আবার ভাল কিছু অর্জন করার পর মাটিতে হামাগুড়ি
দিয়ে মাঠকে চুমো খান। এমন অনেক লেখক আছেন যারা বিশেষ কোনও কলম বা কাগজ ছাড়া
লিখতেই পারেন না।
হ্যালোইন:
বিভিন্ন
পশুপাখি নিয়েও প্রচুর কুসংস্কার রয়েছে মানুষের মনে। গভীর রাতে পেঁচার ডাক শুনলে অমঙ্গল আশঙ্কায় অনেকেরই গা ছমছম করে।
খ্রিস্টান অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোতে যুগ যুগ ধরে এই বিশ্বাস প্রচলিত
যে হ্যালোইন সন্ধ্যায় কবর থেকে দলে দলে উঠে আসে প্রেতাত্মারা। সুনসান রাস্তায় বড় বড় গাছের
আড়ালে ওঁত পেতে থাকে অপদেবতারা। ঝাড়ুর হাতলে বসে জোছনা ভেজা রাতের আকাশ দিয়ে উড়ে যায় ডাইনিরা। তবে ভূত-প্রেত নিয়ে মানুষের এই অমূলক ভীতি
যে হ্যালোইন বা কোনও উৎসব
থেকে জন্ম তা কিন্তু নয়।
আরও বহু বছর আগ থেকে মানুষের
মনে শক্ত শেকড় গেড়েছে এ ধরনের ভয়
এবং এ কুসংস্কারগুলো সহজাতভাবেই
বংশ পরম্পরায় বয়ে চলেছে মানুষ।
আয়না:
ভাঙা
আয়না নিয়ে অনেক দেশেই রয়েছে বদ্ধমূল ভ্রান্ত বিশ্বাস। বাংলাদেশে কুসংস্কারে বিশ্বাসী অনেকে মনে করেন, ভাঙা আয়নায় মুখ দেখলে আয়ু কমে যায়। পুরাকালের মানুষ পানিতে নিজের প্রতিবিম্বকে আত্মার প্রতিচ্ছবি মনে করত। আর এই প্রতিবিম্ব
যদি কোনও কারণে কেঁপে উঠত বা ভেঙে যেত,
তাহলে বিপদ আশঙ্কায় কেঁপে উঠত তাদের মন। পরে যখন আয়না আবিষ্কৃত হয়, কুসংস্কারও পানির প্রতিবিম্ব থেকে উঠে এসে ঠাঁই নেয় আয়নার প্রতিবিম্বে।
হর্স সু:
হর্স-সু বা ঘোড়ার
ক্ষুরের নাল পৃথিবীর অনেক দেশে সৌভাগ্যের প্রতীক বলে বিবেচিত। হর্স-সু তৈরি হয়
সাধারণত লোহা দিয়ে। লোহার প্রতি মানুষের নির্ভরতা সুপ্রাচীনকাল থেকে। তারপরও হর্স-সু অর্ধ-চন্দ্রাকৃতির
হয় বলে এ ব্যাপারটি নালকে
মঙ্গল প্রতীক বলে চিহ্নিত করতে প্লাস পয়েন্ট হিসেবে কাজ করেছে। চাঁদ বিশ্বের সব দেশেই চির
আশীর্বাদের প্রতীক। এ জন্য হর্স-সু ভক্ত তাদের
সদর দরজায় পেরেক দিয়ে গেঁথে রাখে এই সৌভাগ্যের প্রতীককে।
এদিকে সৌভাগ্য যাতে ঘর থেকে দৌড়ে
না পালায় সেজন্য অনেকে গরু বা মোষের শিং
রেখে দেয় বাড়ির সামনের দরজায়।
সৌভাগ্যের সংখ্যা:
পৃথিবীর
অনেক দেশে বিভিন্ন সংখ্যা সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যের প্রতীক
বলে বিবেচিত। যেমন ৭ সংখ্যাকে বিশ্বের
প্রায় সব দেশে সৌভাগ্যসূচক
সংখ্যা বলে ধরা হয়ে থাকে। তেমনি '১৩'-কে গণ্য করা
হয় অপয়া সংখ্যা বলে। আবার ৪৯ সংখ্যাটিকেও খুব
একটা ভালো চোখে দেখা হয় না। ক্রীড়া
জগতে ১০ সংখ্যাটির রয়েছে
অনেক জনপ্রিয়তা। আবার ৯৯ সংখ্যাটিও অনেকে
বিশেষ পছন্দ করে থাকেন।
মাছ:
মাছ
উল্টেছেন কি মরেছেন! এমনকি
আপনার জাহাজ পর্যন্ত উল্টে যাবে। এশিয়ার কোনও কোনও অঞ্চলের নাবিকরা এই কুসংস্কারে বিশ্বাসী।
সাগরে ভ্রমণরত অবস্থায় মাছ খেতে গিয়ে সব সময় একপাশ
থেকে খায় তারা। ভুলেও মাছটি উল্টায় না জাহাজ উল্টে
যাওয়ার ভয়ে। এক পাশ থেকে
মাছ খেতে শুরু করে যখন মাঝখানের কাঁটা বেরিয়ে পড়ে, তখন কাঁটাটা সরিয়ে একইভাবে বাকি অংশটাও শেষ করে।
লবণ:
লবণ
নিয়ে কুসংস্কার আছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। লবণ ফেললে নাকি অমঙ্গল হয়। কখনো যদি হাত থেকে লবণের পাত্র পড়ে যায়, তাহলে অজানা অমঙ্গল থেকে বাঁচতে কুসংস্কার বিশ্বাসীরা এক চিমটি লবণ
চট করে ছিটিয়ে দেয় বাঁ কাঁধে। মানব সভ্যতার ঊষালগ্নে লবণকে জীবনের অত্যন্ত মূল্যবান অনুষঙ্গ বলে ধরা হতো। এমনকি টাকা বা মুদ্রা হিসেবে
লবণের ব্যবহার ছিল ব্যাপক। কাজেই লবণের অপব্যবহার মানে অমঙ্গলকে ডেকে আনা। এবং অমঙ্গলের বাহন হচ্ছে ময়তা, যার অবস্থান বাঁ কাঁধে। লবণ পড়ে গেলে শয়তান যাতে কোনও সুযোগ নিতে না পারে, এজন্য
তার চোখ দুটো অন্ধ করে দেওয়ার জন্য এক চিমটি লবণ
ছিটিয়ে দেওয়া হয় বাঁ কাঁধে।
পেরেক:
সেকালে ইংরেজ বুড়োরা দাঁতের ব্যথা উপশমের জন্য পেরেক পুঁতে দিত গাছে। লোহার আছে রোগব্যাধি সারানোর দৈবশক্তি আর গাছের আছে দুর্ভাগ্যকে তাড়ানোর অদৃশ্য প্রাণশক্তি, এই বিশ্বাস থেকে গাছের গায়ে পেরেক ঠোকার কুসংস্কারটির জন্ম। এখনো কোনও কোনও অঞ্চলের মানুষ দুর্ভাগ্যকে হটিয়ে দেয়ার জন্য কাঠের ওপর বিশেষ কিছু পদ্ধতিতে ক্রমাগত আঘাত করতে থাকে।
ঝাড়ু:
দৈনন্দিন জীবনে ঘর-সংসারের একটি অপরিহার্য উপকরণ হচ্ছে ঝাড়ু। নিয়মিত ঝাড়ু না দিলে চলে না। অথচ এ জিনিসটাকে কতই না অবহেলা করা হয়। কুসংস্কারে বিশ্বাসী কারও যাত্রাপথে একবার ঝাড়ু পড়লেই হলো সারাটা পথ উটকো বিপদের আশঙ্কায় দুরু দুরু করবে বুকটা। আর কারও গায়ে যদি ঝাড়ুর আঘাতে লাগে তা সচেতনভাবেই হোক বা অসচেতন ভাবেই হোক, কপালেও ঠিক ঝাড়ু লেগে গেল তার। নাইজেরিয়াও ঝাড়ু নিয়ে এই কুসংস্কার ঝাড়ুর আঘাত খেলে দুর্ভাগ্যের কোপানলে পড়ে যায় বলে বিশ্বাস করা হয়। আর ঘুম থেকে জেগে যদি কেউ সকাল সকাল ঘরে ঝাঁট না দেয়, তাহলে নাকি মহা অনাসৃষ্টি কাণ্ড ঘটে। রাজ্যের যত অশুভ অকল্যাণ এসে বাসা বাঁধে তার ঘরে।
মাকড়সা:
মাকড়সা
মারলে পাপ হয়। গ্রিকরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে এ কথা। মাকড়সাকে
সেদেশের অনেক বাড়িতেই সম্মানিত অতিথির মতো থাকতে দেওয়া হয়। গ্রীকপুরাণে আছে, আরাক্নে নামে এক মেয়ে দেবী
এথেনার সঙ্গে বুনন প্রতিযোগিতায় বাজি ধরে জিতে যায়। এতে দেবী ঈর্ষান্বিত হয়ে আরাক্নেকে মাকড়সা বানিয়ে ফেলেন। পরে এক সময় অপরাধ
বোধ পেয়ে বসে এথেনাকে। তখন তিনি মাকড়সা আরাক্নেকে নিজের হেফাজতে নিয়ে আসেন। এ জন্য গ্রিকরা
মনে করে, মাকড়সাকে সযত্নে থাকতে দিলে পুণ্য হয়, আর মেরে ফেললে
নেমে আসে অভিশাপ। বাংলাদেশের মুসলমানরা যেমন কুসংস্কার হলেও বিশ্বাস করেন গিরগিটি বা টিকটিকি মারলে
পুণ্য হয়।
ছাতা:
ঘরের
ভেতর ছাতা মেলতে নেই, অমঙ্গল হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে অনেকেই মেনে চলে এই কুসংস্কার। তবে
অন্য দেশেও চালু আছে এই অন্ধবিশ্বাস। ছাতার
কুসংস্কারে বিশ্বাসী পাশ্চাত্যের লোকেরা মনে করে, রোদ-বৃষ্টি ছাড়া অপ্রয়োজনীয় কাজে ছাতা মেলে ধরলে ছাতার আত্মা ক্ষেপে গিয়ে প্রতিশোধ নেয়।
রংধনু:
আইরিশরা
রংধনু দেখলে আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। রংধনু তাদের কাছে সৌভাগ্যের প্রতীক। আর যদি রংধনুর
এ প্রান্ত থেকে ছুটতে ছুটতে ও প্রান্তে যাওয়া
যায় তাহলে নাকি পাওয়া যায় রাশি রাশি সোনার মোহর। তবে সাবধান, ভুলেও কিন্তু আঙ্গুল তাক করে কাউকে দেখানো যাবে না রংধনুকে। তাহলে
নাকি উল্টো প্রবল বর্ষণ অনিবার্য।
প্রচলিত কুসংস্কার:
বাংলাদেশে
বেশ কিছু প্রচলিত কুসংস্কার রয়েছে। শুধু বাংলাদেশ নয় এই ধরনের
কুসংস্কার গুলো ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়ে প্রচলিত রয়েছে। যেমন সাত সকালে ঘুম থেকে জেগে কেউ যদি নিঃসন্তান কাউকে দেখে অমনি অশুভ ধারণা করে বসে। তার মনে বদ্ধমূল ধারণা জন্মে যায় যে, আজকের দিনটা তার মোটেও ভালো যাবে না। বাইরে কোথাও বের হওয়ার সময় কোনও কিছু তে বাধা পড়লে
অনেকে আবার ঘরে একটু বসে যায় কারণ তাদের ধারণা যাত্রার প্রথমে যখন বাধা পড়েছে তাহলে পথে বিপদ হতে পারে। ঘর থেকে বাহির
হওয়ার সময় ঝাঁটা বা ঝাড়ুর সাথে
ধাক্কা খেলে যাত্রা অশুভ মনে করা হয়।
আবার
যাত্রার শুরুতে কেউ হাঁচি দিলে সেটিকেও যাত্রার অশুভ লক্ষণ হিসেবে মনে করা হয়। বাংলাদেশে আরও বেশ কিছু প্রচলিত কুসংস্কারের মধ্যে রয়েছে ঘরে যদি কারও হাত থেকে কিছু পড়ে যায় তাহলে বাইরে নিকট কারও কোনও বিপদ হয়েছে বলে সন্দেহ করা হয়। সেলাই করার সময় সুচ যদি হাতে বিদ্ধ হয় তাহলেও নিকট
কারও বিপদ হয়েছে মনে করা হয়। কারও বাড়ির পাশে যদি কাক এসে কা-কা করে
ডাকতে থাকে তাহলে ধারণা করা হয় বাড়িতে মেহমান
আসছে। এছাড়াও বাড়ির আঙ্গিনায় যদি পোকায় ঘর বাধে তাহলে
সৌভাগ্যের লক্ষণ মনে করা হয়। কারও যদি পা’র তলা
চুলকায় তাহলে ধারনা করা হয় দ্রুত অর্থ
প্রাপ্তির সম্ভাবনা আছে।
আবার
যদি কারও চোখের পাতা লাফায় তাহলে ধারনা করা হয় জীবনে বিদেশ
ভ্রমণের সম্ভাবনা আছে। ছোট বাচ্চাদের ক্ষেত্রে মায়েরা তাদের কপালে টিপ দিয়ে দেয় যাতে কারোও নজর না লাগে। অনেকে
জোতিষ্ঞীর কাছে যান হাত দেখাতে বা টিয়া পাখির
দ্বারা ভাগ্য পরীক্ষা করেন যেগুলো সম্পূর্ণ কুসংস্কার। বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানরা কোনও কিছু প্রাপ্তির জন্য মাজারে মিলাদ-মাহফিল, শিরনী বিতরণ বা মানতের ব্যবস্থা
করে থাকে, যেগুলো পরিপূর্ণ কুসংস্কার। একাজ গুলো দ্বারা কবিরা গুনাহ ছাড়া অন্য কিছু প্রাপ্তি হয় না।
কুসংস্কার প্রত্যেক সমাজের সাথে মিশে আছে। কুসংস্কার গুলো মানুষের সাথে এমন ভাবে মিশে আছে যে তা এখন
সবার কাছে সত্য-সঠিক হিসেবে পরিণত হয়েছে। তবে সমাজের মানুষ যদি সচেতন হয় তবে কোনও
একদিন এই কুসংস্কারগুলো মানব
সমাজ থেকে দূরীভূত হবে।
এরকম
আরও পড়ুন:
কোন মন্তব্য নেই