কুসংস্কার দেশে দেশে (পর্ব ২)
বিশ্বব্যাপী কুসংস্কার বেশ প্রচলিত। প্রত্যেক দেশে দেশে বা সমাজে প্রচলিত রয়েছে নানান ধরনের কুসংস্কার। কোনও কুসংস্কার মন্দভাগ্যকে নির্দেশ করে আবার কোনটি ভাল ভাগ্যের নির্দেশনা প্রদান করে। বিভিন্ন বিষয় বা নানান উপাদানকে কেন্দ্র করে এই সকল কুসংস্কারগুলো তৈরি হয়ে থাকে। কুসংস্কার সত্যিকারভাবে মিথ্যা হলেও মানুষ এগুলো মনের অজান্তে বা মানব স্বভাব হিসেবে বিশ্বাস করে থাকে। গত পর্বে আমরা কয়েকটি বিষয়ের কুসংস্কার সম্পর্কে জেনেছিলাম। আজকের পর্বে আমরা আবার নতুন কিছু বিষয়ের কুসংস্কার সম্পর্কে জানবো।
চেরি ফল:
সুইজারল্যান্ড
বাসী চেরি ফল চাষিদেরকে পরামর্শ
দিয়ে থাকে যে, তারা যেনো তাদের প্রথম ফল গাছ থেকে
পেড়েই একটি ফল একজন নারীর
হাতে দিয়ে দেয়। যার অর্থ হবে ঐ গাছটিতে সব
সময়ই প্রচুর ফল ধরবে। তারা
আরও বিশ্বাস করে যে, একটি আঙ্গুর ক্ষেতের মাঝখানে চেরি ফল গাছ লাগালে
তাতে একই রকমের ভাল ফল পাওয়া যায়
এবং তা দ্বারা ভাল
মদ তৈরি করা যায়। চেরি ফল নিয়ে আর
যে সকল কুসংস্কার রয়েছে তার মধ্যে রয়েছে, তারা চেরি ফল খাওয়ার পর
ফলের আটি গণনা করতো ও সাথে সাথে
গান পরিবেশন করতো এবং এর মাধ্যমে কোন
ব্যক্তির কোন বছর বিয়ে হবে তার হিসাব বের করতো।
অন্যান্য
জিনিসগুলোর মধ্যে রয়েছে বিরক্তিজনক ভাবে চেরির দানাগুলো বিক্ষিপ্তভাবে ছাদের দিকে ফিকে মারার স্বভাব, প্রথম নিক্ষেপেই যদি ছাদ ছুঁয়ে যায় তবে যে ছুড়েছে তার
অতি শীঘ্র বিয়ে হবে। কেন্ট কাউন্টিতে একটা কুসংস্কার প্রচলিত ছিল যে যদি কেউ
চেরি ফলের বাগানে হাঁটার সময় চেরি পাতার সাথে জুতো ঘষা দেয় তাহলে তার গলায় চেরি ফলের আটি আটকে গিয়ে তাকে শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলবে।
বাদাম:
বাদাম
বহুবিধ উপকারী উপাদান হওয়ায় এ নিয়েও রয়েছে
কুসংস্কার। কুসংস্কার বাদীরা ঘোড়া বাদাম ও মিঠা বাদাম
দুটোর ওপরই রয়েছে কুসংস্কার।
আটলান্টিক
মহাসাগরের উভয় তীরে বলা হয়ে থাকে যদি একজন লোক তার সাথে দুটো ঘোড়া বাদাম বহন করে তবে সে গেঁটে বাত,
পিঠের ব্যথা এবং বাত রোগের যন্ত্রণা থেকে রেহাই পাবে। যদি মিঠা বাদামের সাথে মধু ও গ্লিসারিন মিশিয়ে
সেদ্ধ করে খাওয়া যায় তাহলে এজমা রোগও ভালো হয়ে যাবে। কুসংস্কারে এটাও নির্দেশ দেয়া আছে যে, পবিত্র দিনে মৃতদের জন্য উপঢৌকন হিসেবে কিছু মিষ্টি বাদাম টেবিলে সাজিয়ে রেখে দিতে হবে। যা সবার জন্য
মঙ্গল বয়ে নিয়ে আসবে।
গাড়ি:
ইঞ্জিন
চালিত যানবাহনের মধ্যে গাড়ির সবচেয়ে বেশী কুসংস্কার রয়েছে। কিছু
কিছু সমাজে সবুজ গাড়িকে সম্পূর্ণরূপে দুর্ভাগ্যজনক মনে করা হয়। নিরাপদে গাড়ি চালিয়ে আসার পরে কাউকে অভিনন্দন জানানোকেও অজ্ঞতা বলা হয়। কারণ এটা শুধুমাত্র ভাগ্যকে খোঁচা দেয়া হয়। বিশেষ করে মাসের ১৩ তারিখে যদি
গাড়ি কেনা হয় অথবা গাড়ির
নাম্বার প্লেটের সংখ্যাগুলো যোগ দিলে যদি কোনও প্রকার ১৩ হয় তবে
সেটিকে অমঙ্গল ভাবা হয়। অনেক গাড়ির চালক আবার এই ধারণা করেন
যে, গাড়ি ধৌত করলে অবশ্যই বৃষ্টি আসে।
মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রে একটি কুসংস্কার লিপিবদ্ধ করা হয়েছে যে, একটি বালিকা তার প্রকৃত প্রেমিকাকে হঠাৎ করে খুঁজে বের করার জন্য গাড়ির যাদু দেখাতে পারে। প্রথমে সে একই স্থানে
দাঁড়িয়ে থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত না ১০টি লাল
গাড়ি তাকে অতিক্রম করে চলে যায়। তারপর সে একটি রক্তবর্ণাকেশী
বালিকার সাক্ষাৎ পাবে যার পরিধানের কাপড় হবে বেগুনে রঙের এবং সর্বশেষে উপস্থিত হবে একটি সবুজ টাই পরা পুরুষ পরবর্তী যে লোকটি উপস্থিত
হবে সেই হবে ভাগ্যবান পুরুষ যে বালিকাটিকে বিয়ে
করবে বলে ভাগ্যে লেখা আছে।
ঠাণ্ডা:
সাধারণ
ঠাণ্ডা লাগার হাত থেকে বাচার জন্য বেশ কিছু কুসংস্কার আছে। অনেকের ধারণা গির্জায় বসে থাকলে ঠাণ্ডা লাগতে পারে না। অনেকে পরামর্শ দিয়ে থাকে যে, শরৎকালে ওক গাছের পাতা
মাটিতে পড়ার সাথে সাথে যদি একটি পাতা তুলে নেয়া যায় তাহলে তা কিছুটা ঠাণ্ডার
উপশম দিতে পারে। আবার কারোও মতে কমলালেবুর চামড়া খুলে তা নাকের মধ্যে
ঢুকিয়ে ছিদ্র বন্ধ করে দিলে তাও ঠাণ্ডার জন্য একটা যাদুর মতো কাজ করে।
ধূমপান:
ধূমপান
ক্যান্সারের কারণ হলেও ধূমপান এর সাথে বহুবিধ
কুসংস্কার জড়িয়ে আছে। সচরাচর কুসংস্কারগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি এই ধারণা যে,
একজনকে একটা সিগারেট প্রদান করার পর যদি দেখা
যায় যে সিগারেটটি ভাঙ্গা,
তাহলে এটা হবে তার জন্য দুর্ভাগ্যের চিহ্ন, আর ধূমপান করার
সময় যদি সিগারেটটি সঠিকভাবে সব দিক সমান
হয়ে পুড়তে ব্যর্থ হয় তাও হবে
দুর্ভাগ্যের। ধূমপান করার সময়ে যে ধূম্র আংটি
তৈরি হয় তা হাত
দিয়ে ধরে যদি পকেটে রাখা যায় তাহলে তা হবে খুবই
সৌভাগ্যের।
নারীগণ
সিগারেট হাতে নেবার সময় খুব সাবধানতা অবলম্বন করবে। সালেম ও ম্যাসাসুসেট এ
পালিত একটি কুসংস্কার এই যে, যদি
কোনও নারী একটি অবসন্ন সিগারেটের ওপর দিয়ে মাড়িয়ে যায় তবে তার ভাগ্যে আছে পরবর্তী যে লোকটির সাথে
তার দেখা হবে তার সাথেই তার বিয়ে হবে।
চুয়িংগাম:
বিশ্বের
অনেক দেশেই প্রচলিত আছে যে, একটি চুয়িং গাম বা একটি লজেন্স
একসাথে দুজনে ভাগ করে খেলে তা বন্ধুত্ব বা
ভালবাসাকে আরও গাড় করে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের বিংশ শতাব্দীর ধর্মীয় পুরাণে বলা হয়েছে যে, যদি একজন প্রেমিককে একটা লজেন্স এর কাঠি এই
মর্মে প্রদান করা হয় যে সে
তাকে ভালবাসবে, সেই প্রেমিকের কিছুটা অনীহা থাকা সত্ত্বেও যদি সে লজেন্সটি গ্রহণ
করে ও ভালভাবে চিবোয়
তাহলে অন্যান্য যাদুকরী প্রভাব ছাড়াও তাকে ভালবাসতে বাধ্য হবে।
রান্না করা:
বিশ্বে
রান্না করার বিষয়ে রয়েছে অনেকগুলো কুসংস্কার। যার মধ্যে একটি হচ্ছে, জলের পাত্রে বেশি জ্বাল দিতে নেই। কারণ পানি বেশি ফুটানোর দ্বারা পাচক তার প্রেমিক বা প্রেমিকাকে সেদ্ধ
করে দূরে সরিয়ে দেয়। কখনো এক সাথে দুজনে
ভাগাভাগি করে একটা পাত্র নাড়তে নেই, কারণ এভাবে নাড়লে ঝগড়া হওয়ার ভয় থাকে। এছাড়া
কখনো একটা সং-মিশ্রিত জিনিস
নাড়তে নেই পূর্ব-পশ্চিম দিকে অবস্থান করে তাতেও সূর্যের চলাচলকে নকল করা হয়। তাছাড়াও প্রাচীন প্রবাদে বলা হয়ে থাকে যে প্রহরা দেয়া
পাত্রে কখনো কিছু সেদ্ধ হয় না। কেক,
সূপ অথবা অন্য কোনও খাদ্যের মধ্যে আংটি এবং বোতাম গোপন করে রাখা, পূর্বে এটা ছিল বিশেষ অনুষ্ঠানের মধ্যে সময় উপযোগী পন্থা, যার দ্বারা ভবিষ্যদ্বাণী করা হতো পরবর্তীতে কার বিয়ে হবে বা কে আরও
বেশি ধনী হবে।
কফি:
মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রের কুসংস্কার অনুযায়ী এক কাপ কফির
উপরের জল বুদবুদ থেকে
অনেক কিছু দেখার ও শেখার আছে।
যদি বাবলগুলো ভেসে পানকারীর দিকে আসতে থাকে তাহলে তার সামনে আসবে সমৃদ্ধশালী সময়, যদি তারা অন্যদিকে যায় তাহলে সামনে আসবে দু:সময়।
মুদ্রা:
পৃথিবীতে
অনেক লোক আছে যারা ধাতব মুদ্রাকে তাদের ভাগ্যের জন্য দোষারোপ করে থাকে। একটি মুদ্রাকে ঝর্ণা অথবা পুকুরের মধ্যে নিক্ষেপ করলে ভাগ্য শুভ থাকে, এটা একটা চিরন্তন প্রথা। বহু লোকই সৌভাগ্যের মুদ্রা সাথে বহন করে থাকে । জেলেরা সৌভাগ্যের
জন্য একটি মুদ্রা তাদের নৌকার মধ্যে পুতে রাখে অথবা জালের সাথে বেঁধে দেয় এবং আগেকার দিনে গরীব লোকেরা বিশেষভাবে তৈরি একটি মুদ্রাকে স্পর্শ করার জন্য মুদ্রার একখণ্ড তাদের সাথে রাখতো। এই মুদ্রা দ্বারা
শয়তান পরাভূত থাকে এবং অন্যান্য রোগ বালাইয়ের হাত থেকে বাঁচা যায় বলে মনে করা হতো।
বিশেষ
করে ঈশ্বর ভক্তদের পরস্পর কথোপকথনের সময়ে প্রাপ্ত এবং ঝড় বৃষ্টির সময়
মাটির উপরে প্রাপ্ত মুদ্রা হচ্ছে সৌভাগ্যের এবং মনে করা হয় এইগুলো অবশ্যই
স্বর্গ থেকে পতিত হয়েছে। অনেক সমাজে মনে করা হয় একটা মুদ্রা
মাটিতে পড়ে থাকতে দেখলে তা না তুলে
নেয়া দুর্ভাগ্যকে ডেকে আনা। কোনও টাকার থলে, ওয়ালেট বা কোট কাউকে
উপহার দিতে হলে তার মধ্যে প্রথমে কয়েকটি মুদ্রা অবশ্যই রাখতে হবে। এটিও প্রচলিত এক ধরনের কুসংস্কার।
ব্রিটেনে
কিছু মুদ্রা আছে যা দুর্ভাগ্যের প্রতীক।
ডেসিমেল কারেন্সির পূর্বেকার পাঁচ সিলিং এবং ক্রাউন অংকিত মুদ্রা অনেক স্থানেই অপছন্দ করা হতো। বিশেষ করে পাবলিক হাউসগুলোতে অনেকে মনে করতো এইরূপ একটি মুদ্রা গ্রহণ করলে অতি শীঘ্র তার চাকরি চলে যাবে। অনেক দেশেই মৃতের চোখের পাতায় মুদ্রা রেখে দেয়া হয় যাতে চোখের
পাতা না খুলতে পারে
এবং তাদের সঙ্গে এক সাথে কবরে
যাওয়ার জন্য এদিক ওদিক কাউকে খোঁজ করতে না পারে।
কাশি:
ব্রিটিশদের
কুসংস্কারে বলা হতো যে পানিতে বার্লি
গুলে তার মধ্যে তিনটি শামুক দিয়ে সেদ্ধ করে সেই পানি কাশির রোগীকে পান করালে কাশি ভালো হয়ে যায়। সেখানে আরও একটি মজার কুসংস্কার আছে য, রোগীর মাথা
থেকে একটি চুল ছিঁড়ে তা কোনও খাদ্যের
সাথে একটি কুকুরকে এই বলে খাইয়ে
দিলে যে, তুমি অসুস্থ হয়ে যাও এবং আমার রোগ মুক্তি হোক। এই বলে কৃতকার্যতার
সাথে কাজটি করলে কাশি রোগটি মানুষের দেহ থেকে পশুর দেহে চলে যাবে।
আংটি:
ভারতীয়
উপমহাদেশ সহ বিভিন্ন দেশে
প্রচলিত আছে যে, হাতে বিভিন্ন রকমের আংটি পরলে সেটি বিপদাপদ হতে রক্ষা করে এবং ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়। অনেকে ধন-সম্পদ প্রাপ্তির
আশায় হাতে আংটি পরে থাকে। আবার অনেকে শনির বিপদ বা জীবনের বিভিন্ন
বিপদ আপদ থেকে বাচার জন্য হাতে আঙটি পরে থাকে। তবে একথা সত্যি যে, আঙ্গুলে আংটি পরা শুধুই মনের সান্ত্বনা এবং এটি বকে কুসংস্কার। কারণ, জড়বস্তু আঙটির কোনও ক্ষমতা নেই কারোও ভাল-মন্দ কিছু করার।
কুসংস্কার
প্রত্যেক দেশে দেশে আছে। বহু কাল ধরে কুসংস্কার মানুষের সমাজের সাথে মিশে আছে। তবে সচেতন মানুষদের উচিৎ কুসংস্কারের সাথে তাল না মিলিয়ে নিজেকে
পবিত্র রাখা।
এরকম
আরও পড়ুন:
চমৎকার বিষয়। ধন্যবাদ।
উত্তরমুছুনআব্দুল্লাহিল হাদী আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।
উত্তরমুছুন