শরীরের অংকিত সৌন্দর্য ট্যাটু এর ইতিহাস
বর্তমান আধুনিক সমাজে মানব শরীরে ট্যাটু বা উল্কি আঁকানো একটি সাধারণ বিষয়। বিশিষ্ট ব্যক্তি, খেলোয়াড়, অভিনেতা বা সাধারণ মানুষ আজকাল সবাই শরীরে ট্যাটু অংকন করে থাকে। ছোট ছোট শিশুরাও হাতে ট্যাটু লাগানোর জন্য চুয়িংগাম খেয়ে থাকে। মানুষ দেহের বিভিন্ন অংশে যে ট্যাটু একে থাকে তাকে আবার উল্কিও বলা হয়ে থাকে। সাধারণত উপজাতি এবং যারা বনে-বাদাড়ে বাস করে তাদের শরীর অংকনকে উল্কি বলে। প্রাচীনকাল থেকে মানুষের মধ্যে ট্যাটু বা উল্কি আঁকা প্রচলিত ছিল।
ট্যাটু
আঁকানোর ইতিহাস বহু পুরনো। আজ থেকে প্রায়
চার হাজার বছর আগে মিসরীয়রা শরীরে ট্যাটু অঙ্কন করা শুরু করেছিল। গবেষকরা মিসরের মমি কৃত নারীদের নিয়ে গবেষণা করে নিশ্চিত হয়েছেন যে, তারাই বিশ্বে প্রথম শরীরে ট্যাটু অঙ্কন করেছিল। পলেশিয়ান ট্যাটু শব্দের বাংলা অর্থ আকর্ষণীয়, চিত্তহারী কোনও বস্তু। উল্কি হচ্ছে এমন এক ধরনের শিল্প,
যেখানে অমোচনীয় কালি শরীরের ত্বকের রঙ পরিবর্তন করার
জন্য বা অন্য কোনও
উদ্দেশ্যে
ত্বকের
উপরাংশে প্রয়োগ করা হয়। উল্কি মানুষের শরীর সাজানোর একটি অংশ এবং প্রাণীদের ক্ষেত্রে উল্কি করণ করা হয় মূলত নির্ধারণ
ও ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য পৃথিবীর অনেক দেশেই ট্যাটু আঁকা খুবই জনপ্রিয়। কোনও কোনও অঞ্চলের অধিবাসীদের ক্ষেত্রে ট্যাটুর মাধ্যমেই পাওয়া যায় তাদের বংশ পরিচয়। জাপানের আইনু আদিবাসীরা প্রথাগতভাবেই মুখে ট্যাটু আঁকে। নিউজিল্যান্ডের মাওরি, উত্তর আমেরিকার তামাজঘাসহ আমেরিকা ও ইউরোপের অনেক
জাতির মধ্যে ট্যাটু তাদের বংশগত বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে।
সহজে
শনাক্তকরণের জন্য রোমান রাজারা সৈনিকের হাতে বাধ্যগতভাবে ট্যাটু আঁকতে নির্দেশ দিতেন। জাপানের ইয়াকুজা নামক অপরাধ চক্রের সঙ্গে জড়িতদের শরীর জুড়েই থাকে ট্যাটু। তবে ট্যাটু যে শুধু পরিচয়ের
স্বাক্ষর বহন করে তা নয়। আরও
অনেক উদ্দেশ্যেই তা ব্যবহৃত হয়।
লাওস, থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার অনেকেই
মনে করেন, ট্যাটু তাদের শত্রু থেকে
রক্ষা করে ও এটা তাদের
ভাগ্যের জন্য সহায়ক। আবার প্রসাধনী হিসেবেও ট্যাটুর ব্যবহার প্রচলিত। কৃত্রিম তিল আঁকা, চোখের ভ্রু ও ঠোঁটের সৌন্দর্য
বৃদ্ধিতে ট্যাটু এঁকে নেয় অনেকে, যা স্থায়ী মেকআপের
মতো কাজ করে।
বর্তমানে
সিনেমার নায়ক-নায়িকা, খেলোয়াড়, রেসলার ও যৌনকর্মীদের মধ্যে
ট্যাটু আঁকার প্রচলন বেশী দেখা যায়। ট্যাটু বর্তমানে দেহের বিভিন্ন অংশে অংকন করা হয়, এমনকি নারী-পুরুষেরা তাদের গোপনাঙ্গেও ট্যাটু অংকন করিয়ে নেয়। ইউরোপ ও আমেরিকা মহাদেশের
অধিবাসীরা বেশী ট্যাটু অংকন করে থাকে। ২০০৫ সালের এক জরিপে দেখা
গেছে, আমেরিকান সমাজে সার্জারি করে শরীরে স্থায়ীভাবে ট্যাটু করা হয়। ২০০৬ সালের এক হিসাবে দেখা
গেছে, যারা শরীরে উল্কি আঁকায়, তাদের অধিকাংশই তরুণ এবং এদের বয়স আঠারো থেকে উনত্রিশের মধ্যে।
বিশ্বের
সবচেয়ে বেশি উল্কি ওয়ালা লোকটির নাম টম লেপার্ট। যার
বাড়ি স্কটল্যান্ডে। এ লোকটি তার
শরীরের ৯৯.৯ শতাংশ
অংশই অঙ্কন করেছিলেন ট্যাটু দ্বারা। এই ট্যাটু অংকন
করার মধ্য দিয়ে তিনি গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে
নামও লিখিয়েছিলেন। ট্যাটু অংকন করার জন্য বর্তমানে বিশ্ব জুড়ে অনেক প্রসিদ্ধ ট্যাটু অংকন কেন্দ্রও গড়ে উঠেছে। এমনকি প্রতি বছর সেরা ট্যাটু বাছায়ের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে প্রতিযোগিতাও হয়ে থাকে।
ট্যাটু
দেখতে সুন্দর কিন্তু এটি অংকন করা কিন্তু সহজ নয়। ট্যাটু অংকনের সবচেয়ে প্রচলিত পদ্ধতি হলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সুচের সাহায্যে শরীরের মধ্যে অতিসূক্ষ্ম ছিদ্র করা হয়। এভাবে ছিদ্র করে একটি আকৃতি এঁকে নেয়া হয়। তারপর সেখানে অমোচনীয় কালি বা রং বসিয়ে
ট্যাটুকে ফুটিয়ে তোলা হয়। ট্যাটু অংকন অত্যন্ত ব্যথা দায়ক কাজ, যা সবাই সহ্য
করতে পারে না। ট্যাটু আঁকার জন্য নানান ধরনের কালি ব্যবহার করা হয়। যার মধ্যে আছে ইন্ডিয়ান ইঙ্ক, কার্বন, সিঁদুর, ক্রোমিক এসিড, ইন্ডিগো, প্রুসিয়ান ব্লু, কোবাল্ট ইত্যাদি। এসব কালি ত্বকের অন্তঃস্থরে দীর্ঘদিন ধরে অমোচনীয় অবস্থায় থাকে।
বর্তমানে
বাজারে ট্যাটু অংকনের মেশিনও রয়েছে, যার দ্বারা নিখুঁতভাবে শরীরে ট্যাটু অংকন করা যায়। শরীরে ট্যাটুর অংকনের অনেক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও রয়েছে। ট্যাটু আঁকানোর ফলে ত্বকে বিভিন্ন রোগ সৃষ্টি হতে পারে, এমনকি এইডসও ক্যানসার হতে পারে। তবে অক্ষতিকর ক্ষণস্থায়ী ট্যাটুও আঁকা যায়, এতে সুচ দিয়ে শরীরে ছিদ্র করার কোনও ভয় থাকে না।
শরীরে আঁকা স্থায়ী ট্যাটু চাইলে মুছে ফেলা সম্ভব। তবে তা এঁকে নেওয়ার
চেয়ে বেশি ব্যথা দায়ক ও খরচ সাপেক্ষ।
এ ক্ষেত্রে বর্তমানে লেজার চিকিৎসা বহুল ব্যবহৃত হচ্ছে। ট্যাটু নিয়ে একটি মজার কাহিনীও রয়েছে।
১৯৩৫
সালের দিকে অস্ট্রেলিয়ায় জেমস স্মিথ নামক এক ভদ্রলোক নিখোঁজ
হন। তার নিখোঁজ হওয়ার ১৪ বছর পর
সমুদ্র থেকে ধরে আনা একটি হাঙ্গর একুরিয়ামে বমি করে একটি হাত উগড়ে দেয়। মেডিকেল পরীক্ষা থেকে তথ্য পাওয়া যায়, লোকটিকে হত্যা করার পর তার হাতটি
কোনও ধারালো অস্ত্র দিয়ে কেটে ফেলা হয়েছিল এবং সেই হাতটি এই হাঙ্গরটি গিলে
ফেলেছিল। সেই হাতের মধ্যে আঁকা দু'জন মুষ্টি
যুদ্ধরত লোকের ট্যাটু থেকে লোকটির স্ত্রী ও পুত্র তাকে
শনাক্ত করতে পেরেছিলেন। ফিঙ্গার প্রিন্টের মাধ্যমে পরে তা নিশ্চিতও করা
হয়। এরপর হত্যাকারীও ধরা পড়েছিল।
ট্যাটু
ব্যাথা দায়ক হলেও এর প্রচলন কমছে
না, বরং প্রতিবছর ঠিকই এর প্রচার ও
প্রসার বৃদ্ধি পাচ্ছে। ট্যাটুর প্রতি সেলিব্রেটিদের আগ্রহ থাকায় তাদের দেখাদেখি সাধারণেরাও দিন দিন এর প্রতি আগ্রহশীল
হয়ে পড়ছে।
কোন মন্তব্য নেই