সুন্দরী প্রতিযোগিতার অতীত ও বর্তমান
সুন্দর একটি স্পর্শকাতর বিষয়। মানুষ সুন্দরের পূজারী। হয়তো অনেকে বলতে পারেন আমার কাছে সবাই সমান তবে তিনি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন না যে, সুন্দর তাকে আকৃষ্ট করে না। আর সেটি যদি হয় নারী বিষয়ের তবে অবশ্যই সেটি আরও কাঙ্ক্ষিত বস্তু হয়ে দাড়ায়। মহান সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীর সকল মানুষকে সমান বা সবাইকে একই সুন্দর অবয়বে সৃষ্টি করেন নি। সাদা-কালো, লম্বা-বেটে নানান ধরনের মানুষ আছে পৃথিবীতে।
পুরুষ কি মহিলা
সকল মানুষই বিভিন্ন অবয়বে সৃষ্ট। মানুষের চেহারা বা আকৃতি তার নিজের তৈরি করা
জিনিস নয় বরং এটি সৃষ্টিকর্তা প্রেরিত নির্দিষ্ট একটি বিষয়। সেজন্য কাউকে খারাপ
চেহারার বলে ভৎসনা করা, হিংসা করা বা
গালি দেওয়া মস্ত বড় অন্যায়। তেমনিভাবে আরও বড় অন্যায় মানুষের মাঝে সুন্দরকে খুঁজে
বের করা এবং তাদের নির্দিষ্ট করে পুরস্কৃত করা, কারণ এতে অসুন্দর মানুষেরা মনে গভীর কষ্ট পেয়ে
থাকে। সেই সাথে এটি মানবতার চরম লঙ্ঘন। মানবতার লঙ্ঘন হওয়া সত্ত্বেও সুন্দরের পূজা
থেমে নেই। তাইতো বিশ্বব্যাপী প্রচলিত রয়েছে সুন্দরী প্রতিযোগিতা। বর্তমানে বিশ্বের
বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন নামে সুন্দরী প্রতিযোগিতা হয়ে থাকে। সুন্দরী প্রতিযোগিতা
যে হঠাৎ-ই শুরু হয়েছে তা কিন্তু নয়, কারণ এরও রয়েছে একটি ইতিহাস।
সেই সুপ্রাচীনকাল
থেকেই ব্যক্তিগত ও রাজপরিবারের প্রয়োজনে সুন্দরী প্রতিযোগিতার কাজটি চলে আসছে। মে'
ডে এর রাজা রানী বাছাইয়ের
বহু আগে থেকেই ইউরোপে সুন্দরী প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল। এই প্রতিযোগিতায় একজন নারী
নির্বাচন করা হতো, যিনি মূলত তার
দেশের প্রতিনিধিত্ব করত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সুন্দরী প্রতিযোগিতা শুরু হয় ১৮৫৪
সালে। কিন্তু তখনকার রক্ষণশীল সমাজেও সভ্য নেতৃবর্গের কারণে একসময় তা বন্ধ হয় যায়।
পরবর্তী সময়ে আবার সুন্দরী প্রতিযোগিতা শুরু হয় তবে সেটি শুরু হয়েছিল 'ফটো সুন্দরী প্রতিযোগিতা'
নামে।
আধুনিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার সূচনা হয়েছিল ১৯২১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। প্রথমে এটি মানুষদের মাঝে সাড়া জাগাতে ব্যর্থ হয়। পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রে শুরু হয় সেনাবাহিনীতে সুন্দরী নারীর প্রতিযোগিতা। তারপর এটি থেকেই শুরু হয় 'মিস ইউনিভার্স' প্রতিযোগিতার ছোট একটি রূপ। ১৯৫১ সালে অনুষ্ঠিত সুন্দরী প্রতিযোগিতায় যিনি 'মিস আমেরিকা' খেতাব জয় করেছিলেন তিনি রক্ষণশীলদের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হন। এরপর আয়োজন করা হয় 'মিস ইউএসএ' এবং 'মিস ইউনিভার্স' প্রতিযোগিতা।
১৯৫২ সালে
ক্যালিফোর্নিয়ায় প্রথম এই প্রতিযোগিতা শুরু হয়। প্রথম 'মিস ইউনিভার্স' নির্বাচিত হন ফিনল্যান্ডের আরসি কুন্সিলা।
প্রথম দিকে সুন্দরী প্রতিযোগিতা টিভিতে প্রচার করা হতো না। টেলিভিশনে মিস
ইউনিভার্স অনুষ্ঠানটির প্রথম প্রচার শুরু করা হয় ১৯৫৫ সালে। প্রথমে 'মিস ইউনিভার্স' এবং 'মিস ইউএসএ' অনুষ্ঠান দুটি টিভিতে যৌথভাবে
প্রচার করা হতো। পরবর্তীতে ১৯৬৫ সাল থেকে আলাদাভাবে অনুষ্ঠান দুটির প্রচার শুরু
হয়। এভাবেই এক সময় সুন্দরী বাছাইয়ের ব্যাপারটি বিশ্বজুড়ে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ
করে।
সৌন্দর্যের
যোগ্য মূল্যায়ন ও তাদের সম্মান দেওয়ার জন্য প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে বেশ কয়েকটি সুন্দরী
প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। সুন্দরী প্রতিযোগিতা নিয়ে এখনও প্রবল বিতর্ক থাকলেও
গোটা বিশ্বজুড়ে বর্তমানে এটি আগ্রহ এবং উন্মাদনার একটি প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আপনারা ভাবছেন শুধুমাত্র নারীদের নিয়ে সুন্দরী প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয় তা
কিন্তু নয়। প্রতিবছর বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে যুবকদের অংশ গ্রহণে সুন্দর
প্রতিযোগিতাও অনুষ্ঠিত হয়।
সুন্দরী বাছাইয়ের
সবচেয়ে বড় প্রতিযোগিতার নাম 'মিস ইউনিভার্স'। এটি একটি বার্ষিক
সুন্দরী নির্বাচন প্রতিযোগিতা। শুরুর দিকে ১৯৫২ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার ক্লথিং
কোম্পানি 'প্যাসিফিক মিলস'
নামের একটি প্রতিষ্ঠান এই
প্রতিযোগিতা পরিচালনা করত। ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত তাদের নিয়ন্ত্রণেই ছিল প্রতিযোগিতাটি।
এরপর ১৯৯৬ সালে 'ডোনাল্ড
ট্র্যাম্প' এই প্রতিযোগিতা
আয়োজনের দায়িত্ব গ্রহণ করে। বর্তমানে 'মিস ইউনিভার্স অর্গানাইজেশন' নামের একটি সংগঠন প্রতিযোগিতাটি পরিচালনা করে
থাকে।
বর্তমান
দায়িত্বপ্রাপ্ত সংগঠন 'মিস ইউনিভার্স
অর্গানাইজেশন' ২০০২ সালের ২০
জুন তারিখ থেকে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত
প্রতিযোগিতাটির আয়োজন কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তবে ধীরে
ধীরে এর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকলে প্রতিযোগিতাটির ব্যপ্তিও বৃদ্ধি পায়। সুন্দরী
প্রতিযোগিতার মধ্যে মিস ইউনিভার্স সবার থেকে আলাদা। কারণ এই প্রতিযোগিতায়
শুধুমাত্র নারীর সৌন্দর্যকে বিচার করা হয় না। সেজন্য মিস ইউনিভার্স প্রতিযোগিতায়
নারীদের গায়ের রং কোনও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়।
এখানে শারীরিক
সৌন্দর্যের পাশাপাশি নারীর ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধিমত্তা, সাহস, চতুরতা, মানসিকতা, সাধারণ জ্ঞান ইত্যাদি
মূল্যায়ন করা হয়। নেপাল ও আর্মেনিয়া মত বিশ্বের অনেক দেশ অর্থ সঙ্কটের দরুন এই
প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে না। আর প্রতিবার অংশ গ্রহণ করার মধ্যে রয়েছে কানাডা,
ফ্রান্স, জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্র
দেশগুলি। ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞার কারণে মুসলিম দেশগুলো এই প্রতিযোগিতায় তাদের
প্রতিযোগী পাঠায় না।
প্রতি বছর মিস ইউনিভার্স প্রতিযোগিতা শুরুর আগে নির্ধারিত সময়ের আগে প্রতিষ্ঠানটি প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণেচ্ছু দেশের জাতীয়ভাবে নির্বাচিত সুন্দরীদের তালিকা আহবান করে। কোনও দেশে জাতীয়ভাবে সুন্দরী প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত না হয়ে থাকলে প্রতিষ্ঠানটি নির্ধারিত মডেল এজেন্সির মাধ্যমে সেই দেশ থেকে প্রার্থী নির্বাচন করে থাকে। সুন্দরী প্রতিযোগিতায় প্রতিযোগীর সর্বনিম্ন বয়স হতে হয় ১৮ বছর। অনেক প্রতিযোগীকে ছাটাই করার পর সেমিফাইনালে পাঁচজন সুন্দরীর মধ্যে তিনজন সুন্দরী নির্বাচন করা হয়। এদের মধ্যে চ্যাম্পিয়ন হন যিনি তাকেই বলা হয় 'মিস ইউনিভার্স'।
বাকি দুজন প্রথম
রানার আপ এবং দ্বিতীয় রানার আপ নির্বাচিত হন। যিনি 'মিস ইউনিভার্স' খেতাব জয় করেন তিনি একটি চুক্তিপত্রে
স্বাক্ষরের মাধ্যমে চুক্তিবদ্ধ হন এবং ওই কোম্পানির পক্ষ থেকে চুক্তির মেয়াদকাল
পর্যন্ত বিভিন্ন জনসচেতনতামূলক কাজ করেন। এছাড়া তার জন্য পুরস্কারের ছড়াছড়ি তো
থাকেই। বিশ্বজুড়ে খেতাব অর্জনের খ্যাতি ছাড়াও নানান রকম আলিসান জীবনযাপনের
ব্যবস্থা করা হয় মিস ইউনিভার্সের জন্য।
মিস ইউনিভার্স
হওয়া সত্ত্বেও পরে আবার মুকুট কেড়ে নেওয়ার ঘটনাও আছে। ২০০২ সালে রাশিয়ার 'আক্সানা সানজুয়ান'
মিস ইউনিভার্স নির্বাচিত
হলেও চুক্তি অনুযায়ী কাজ না করায় তার মুকুটটি পরবর্তীতে পরানো হয় প্রথম রানার আপ
পানামার জাস্টিন পাসেককে। বিশ্বজুড়ে সমাদৃত এই আয়োজনটি বর্তমানে প্রতি বছর প্রায়
দেড়শ কোটিরও বেশি দর্শক টিভি পর্দায় উপভোগ করে থাকে।
মিস ইউনিভার্সকে
মূলত একটি ব্যবসা বলা যেতে পারে। আর এই ব্যবসার পণ্য হয়ে থাকেন সুন্দরী নারীরা।
বিশ্বব্যাপী নারীদের সম মর্যাদার বিষয়ে সোচ্চার আলোচনা চললেও তারাই আবার এই সকল
ব্যবসার মাধ্যমে নারীদেরকে ব্যবসায়িক পণ্য বানিয়ে ফেলেছেন। মিস ইউনিভার্স প্রতিযোগিতা
ক্রমে যেভাবে নগ্নতায় পরিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে তাতে এটিকে একটি প্রতিযোগিতার বদলে
নারীর শরীর প্রদর্শনের উৎসব বললেও ভুল হবে না। নারীদের মর্যাদা ক্রমেই নিঃশেষ করে
ফেলছে এই সকল প্রতিযোগিতাগুলো।
কোন মন্তব্য নেই