নওগাঁর ঐতিহাসিক ভিমের পান্টি !
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম একটি রাষ্ট্র বাংলাদেশ। চির সবুজ ও নদী মাতৃক বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে লুকিয়ে আছে শত-সহস্র দর্শনীয় ও ঐতিহাসিক স্থান। যার মধ্যে একটি অন্যতম ঐতিহাসিক স্থান নওগাঁর ভিমের পান্টি। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের রাজশাহী বিভাগের বৃহত্তম একটি জেলা নওগাঁ। ১১টি উপজেলা নিয়ে গঠিত এই জেলাটি। নওগাঁ সদর থেকে ৬৫ কিলোমিটার দূরে উত্তর সীমান্ত ঘেঁষা একটি উপজেলার নাম ধামইরহাট।
নওগাঁর
এই উপজেলায় বেশ কয়েকটি ঐতিহাসিক নিদর্শন রয়েছে। যেমন, জগদল বিহার, আলতা দিঘি, মাহিসন্তোষ, শালবন বিহার ও ভিমের পান্টি।
নিদর্শনগুলোর মধ্যে ভিমের পান্টি অন্যতম। নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলার একেবারে পূর্ব প্রান্তে জয়পুরহাট জেলার সীমানা ঘেঁষে জাহানপুর ইউনিয়নের মুকুন্দপুর-হরগৌরি এলাকায় ১৭০ মি. এবং উচ্চতা ১০ মি. আকারের
একটি ঢিবি রয়েছে। বিভিন্ন আকারের ১৪টি পুকুর রয়েছে এই ঢিবিতে। এই
১৪টি পুকুরের মধ্যে অন্যতম দুটি পুকুর হচ্ছে 'অমৃতকুণ্ড' ও 'কোদাল ধোয়া'।
দিঘির
পশ্চিম পাড়েও আরেকটি ঢিবি রয়েছে। এই ঢিবিটি কিভাবে
রূপান্তরিত হয়েছে তা জানা না
গেলেও এর সর্বত্র ইটপাটকেল
ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে দেখা যায়, আবার কোথাও কোথাও ইটের গাঁথুনির চিহ্নও দেখা যায়। এলাকাবাসীর কাছ থেকে জানা যায়, প্রায় দেড়’শ থেকে দু’শ বছর আগে
রিবেশ্বর-ব্রহ্মচারী নামে জনৈক এক সাধক এ
ঢিবিতে কালো পাথর উৎকীর্ণ মাঝারি আকারের একটি মূর্তি পেয়েছিলেন। তাই তিনি ঢিবির উপর ছোট আকারের চারটি মন্দির নির্মাণ করে ওই মূর্তিটি সেখানে
স্থাপন করেছিলেন।
ওই
সময় বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট লেখক মোশাররফ হোসেন তৎকালীন সময়ে ভিমের পান্টি দেখতে এসে ১৯৭৮ সালে ঢিবিটি থেকে একটি চোকলাতোলা কালো পাথরের উমামহেশ্বর মূর্তি উদ্ধার করেন। এর শৈলী ছিল
অনেকটা খ্রি. ১২-১৩ শতকের
প্রথা সিদ্ধতার মতো। ঢিবির উপর উত্তর-পশ্চিম কোণে ২.৩৯ মি.
ও ৯ সেমি. পরিসরের
এক কোঠাবিশিষ্ট একটি পূর্বমুখী স্থাপনা ছিল। তবে বর্তমানে এটির ছাদ ভেঙে গেছে।
এর
কার্নিশ ছিল অঙ্কিত। পলিস্তারে মসলা হিসেবে সুরকির ব্যবহার ছিল লক্ষণীয়। এই স্থাপনার দক্ষিণে
৫৮ সে.মি. দূরত্বে
উত্তর-দক্ষিণে লম্বা অনুরূপ আরও একটি ভাঙা দেয়াল ছিল। ওই দেয়ালের উচ্চতা
ছিল ১.২২ মি.। কিন্তু বর্তমানে
ভেঙে তার উচ্চতা অনেকটা কমে গেছে। বর্তমানে এগুলোর নিদর্শন নিশ্চিহ্ন করে সেখানে নতুন মন্দির নির্মাণ করা হয়েছে।
ঢিবির
পাদদেশ থেকে দক্ষিণ দিকে বিস্তীর্ণ ফসলি জমি শুরু। দূরে একটি উঁচু পাড়ওয়ালা দিঘিও রয়েছে। তবে এ প্রত্নস্থলের সবচেয়ে
গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন হলো একটি একখণ্ড কালো পাথরের থাম। যার নাম ভিমের পান্টি। যা ঢিবিটি থেকে
মাত্র ৮১ মি. দক্ষিণে
ফসলি জমির মাঝে সামান্য হেলে সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। স্থানীয় জনগণের কাছে এটি ভিমের পান্টি আবার কেউ কেউ কৈবর্ত রাজার ভিমের পান্টি বলে। দেখতে অনেকটা প্রলম্বিত মোচার মতো। এই থামের গা
অত্যন্ত মসৃণ। পাদমূলে এর বেড় ১.৮০ মি. এবং
বর্তমানে এর উচ্চতা ৩.৭৯ মি.।
অতীতে
এর উপর একটি বিষ্ণুর বাহন বা অর্ধ পাখি
বসানো ছিল। কিন্তু বজ্রপাতের আঘাতে সেটি নিশ্চিহ্ন হওয়াসহ থামের মূল অংশের একটি ফালি ধসে গেছে। তবে অক্ষত থাকা অংশের ৫৬.৭ সে.মি. ও ৪৯.৩
সে.মি. পরিমাপের একটি চতুষ্কোনাকার উপরের অংশ আজও ২৮ পঙক্তির একটি
সংস্কৃত ভাষ্য উৎকীর্ণ রয়েছে। এর বর্ণগুলো সুধ্যামৃত
নমুনা রীতির। ১৮০৬ সালে ৫ কিলোমিটার পশ্চিমে
বাদল নামক স্থানে অবস্থিত নীলকুঠির কর্মকর্তা চার্লস উইলকিনসনের একটি ইংরেজি অনুবাদ লন্ডন থেকে প্রকাশিত এশিয়াটিক রিসার্চ পত্রিকার প্রথম খণ্ডে প্রকাশ করেছিলেন।
ভিমের
পান্টি নওগাঁ সহ আশে-পাশের
জেলার মানুষের কাছে বেশ পরিচিত। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষেরা ভিমের পান্টি দেখতে সেখানে ভিড় করেন। দেশের বাইরে থেকেও অনেক পর্যটককে এই স্থানটি দেখতে
আসতে দেখা যায়।
কোন মন্তব্য নেই